নিউজবাংলাডেস্ক:
বাবা পেশায় চিকিৎসক। করোনাকালের পুরো সময়টাই পেশাগত কাজে ব্যস্ত ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত করোনা ইউনিটে। একমাত্র মেয়ে জুনাইনা ভূঁইয়া আরিশা। গত তিন-চার মাস ধরেই আগের মতো বাবাকে কাছে পায় না, আদরও পাচ্ছে না। তার এই ছোট্ট বয়সে যেখানে একটি রাতও বাবাকে ছাড়া ঘুমায়নি সেখানে এখন বাবাকে ছাড়াই সপ্তাহ কেটে যায় তার। এমনো হয়েছে করোনা ঝুঁকির কারণে একটানা ১৪ দিন বাবার কাছে ঘেঁষতেও পারেনি আরিশা। আর এই সময়টাতে নরম হৃদয়ের অব্যক্ত মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিটি ক্ষণ ছটফট করেছে সে। আরিশার মায়ের ভাষ্য মতে, বাবার অবর্তমানে প্রায় সময়েই অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তাদের মেয়ে।
রাজধানীর রামপুরায় ছয়তলা একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন সিরাজুল ইসলাম। পেশায় ব্যবসায়ী। করোনায় লগডাউনের পুরো সময়টাতেই বাসায় ছিলেন তারা। বাসার নিচে শিশুদের খেলাধুলার খোলা জায়গা থাকলেও এক দিনের জন্যও সেখানে খেলতে যাওয়ার অনুমতি পায়নি শিশুরা। বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থেকেই সময় কেটেছে তাদের। দীর্ঘ সময়ে টিভি দেখে কিংবা মোবাইলে গেম খেলে সবকিছুতেই যেন একঘেয়েমি এসে গেছে তাদের। আগের মতো স্বাভাবিক খাবার দাবারেও এখন তাদের অরুচি দেখা দিয়েছে।করোনার এই মহামারীতে সারা দেশেই শিশু-কিশোরদের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত। সার্বক্ষণিক বাসায় থাকার সুবাধে বাবা-মায়ের অতিরিক্ত যতœ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও মানসিকভাবে কোনো শিশুই সন্তুষ্টি পাচ্ছে না। রাজধানীর অনেক শিশু দীর্ঘ দিন ধরেই একঘরে বন্দী অবস্থায় দিন পার করছে। এ দিকে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বারবারই শিক্ষার্থীদের ঘরের বাইরে বের না হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকারও নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে শিশুরা তাদের সহজাত অভ্যাসের বিপরীতে কিছু করতে গেলেই মনের ওপর চাপ পড়ে। তারা যা করতে চায় তা করতে না পারাটা তাদের মানসিক যন্ত্রণার অন্যতম কারণ।
রাজধানীর ইস্কাটন বিয়াম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী লিসা। বাবা চাকরিজীবী। স্কুল বন্ধের পুরোটা সময়েই সে বাবা-মায়ের সাথে মগবাজারের বাসায় লগডাউনে ছিল। বান্ধবীদের সাথে স্কুলের টিফিনে চটপটি ফুসকা আর ঝালমুড়ির লোভ তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। এ ছাড়া বন্ধুদের সাথে স্কুলের মাঠে খেলাধুলা আর বিকেলে কিংবা সপ্তাহের ছুটির দিনে বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে যেতে না পারার ব্যথাটাও সে বেশি অনুভব করছে। তবে অভিভাবকদের দাবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরেই যেন শিশুদের অতিরিক্ত পড়ার জন্য চাপ দেয়া না হয়। এতে শিক্ষার্থীদের মনে দীর্ঘ দিন পর একটি ভীতি সৃষ্টি হবে। তাই প্রথম অবস্থায় কিছু দিন শিশুদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে তারপরেই পড়ার টেবিলে বসাতে হবে।
ঢাকার শিশু হাসপাতালের ডেভেলপমেন্টাল পিডিয়াট্রিশিয়ান ডা: রিয়াজ মোবারক জানিয়েছেন, করোনার এই সঙ্কটের সময়ে কোনো কোনো পরিবারে খাদ্য সঙ্কটে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে অনেক শিশু একাকিত্বে ভুগছে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশিষ্ট এই চিকিৎসকের ভাষায় দীর্ঘদিনের আবদ্ধ অবস্থা শিশুর সব ধরনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। একটা শিশু যখন হাঁটতে শেখে, কথা বলতে, দৌড়াতে শেখে, ছবি আঁকে, নাচে এসব জিনিস শিশুর বিকাশের একটা অংশ। শিশুর সকল ধরনের বিকাশ, বুদ্ধির বিকাশ এই পরিস্থিতিতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া শিশুর সময় কাটানোর জন্য আরেকটা শিশুর বা বন্ধুর দরকার হয়। করোনার কারণে সেটাও সে পাচ্ছে না।
বিশিষ্ট মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানী ডা: মুহিত কামাল নয়া দিগন্তকে জানান, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা এক প্রকার বাধ্য হচ্ছে ঘরে বন্দী থাকতে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকেও ঘরে থাকার নির্দেশনাই বার বার দেয়া হচ্ছে। এতে শিশুদের মনের ওপর একটি অপ্রত্যাশিত চাপ তৈরি হয়েছে। এটা অনেক শিশুই সহজে মানতে পারছে না। বিশেষ করে যেসব শিশু বাইরে খেলাধুলা করে তারা বেশি মানসিক চাপে রয়েছে। আর শিশুদের এই মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তাদের আচরণে। তবে এ ক্ষেত্রে শিশুদের মানসিক এই চাপ কমাতে বাবা-মাকে তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। তাদের সাথে খেলাধুলা করতে হবে। শিশুদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।