সৈয়দ তোশারফ আলী
ইসলামী ইবাদত, সালাতের সঙ্গে অন্য কোন ইবাদতের তুলনা হয় না। কারণ, সামাজিক সাম্যের ধারণাকে সালাতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। মসজিদে গিয়ে ফরজ সালাত জামায়াতে আদায় করার বিশেষ তাৎপর্য হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান বিভেদ বৈষম্যকে অস্বীকার করে ইমামের পিছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যথারীতি রুকু-সিজদা করা, সবার কল্যাণ কামনা করা, দোয়া ও মোনাজাত করা। সমাজে কার কি অবস্থান, কে গোত্রপতি, কে দাসপ্রভু আর কে দাস, কে আমীর আর কে ফকির, কে রাজা আর কে প্রজা, কে এমপি, কে মন্ত্রী আর কে সাধারণ নাগরিক সেটা নামাজের কাতারে দাঁড়াবার ক্ষেত্রে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। সালাত হচ্ছে অসীম সত্তার সঙ্গে সসীম সত্তার কথপোকথন। সালাত থেকে আল্লাহ্র অনুগত বান্দারা পাচ্ছে ঐক্যের চেতনা, সাম্যের চেতনা। পাচ্ছে শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা। শরীর ও মনের পরিচ্ছন্নতা। আরবদের চরিত্রে এসব গুণের সঞ্চার করার কাজটি যে কতটা কঠিন ছিল সেটা ইসলামের উন্মেষ, বিকাশ ও বিজয়ের কাহিনী যারা পড়েছেন তারা জানেন। সালাত আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এর সঙ্গে যাকাতের বিধান জুড়ে দেয়ার কারণে। সামাজিক সাম্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সালাত ও যাকাতকে ব্রাকেটবন্দি করা হয়েছে। একজন মুসলমান অপর একজন মুসলানের ভাই। আদর্শিক এই ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিফলন যেমন লক্ষ্য করা যায় সালাতে তেমনি তা আরও স্পষ্ট হয় যাকাতে। ইসলাম উৎপাদনমূলক কর্মকান্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে সর্বোতভাবে। মানুষ যেহেতু এককভাবে বাঁচতে পারে না, তাই তাকে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের দাবি পূরণ করেই ধর্ম পালন করতে হয়। যারা ভাগ্যবান ও বুদ্ধিমান কেবল তাদেরকে নিয়ে ইসলামী সমাজ নয়। যারা ভাগ্যহত, যারা পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী, যারা আয়-রোজগারে অক্ষম, যারা অনাথ ও মাতৃপিতৃহীন তাদের পাশে দাঁড়াবার, তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবার জোরালো তাগিদ দিয়েছে কোরআন। আদর্শের ভাই হিসেবে তাদের অংশ রয়েছে স্বচ্ছলব্যক্তির ধন-সম্পদে। যাকাত, ফিতরা কিংবা মৃতের রেখে যাওয়া সম্পদের ভাগ-বণ্টনের ব্যাপারটা কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয় নাই। কারণ, কোরআন বলছে, মানুষ স্বভাবতই কৃপন। অংশিদারকে বঞ্চিত করার প্রবণতা মানুষের রক্তে-মজ্জায়। তাই দেখা যায়, রক্ত সম্পর্কের ভাই তার ভাইকে, বোনকে ঠকাচ্ছে। ইসলাম এই ঠকবাজির বিরুদ্ধে। কাউকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা কোরআন সমর্থন করে না। তাই যারা মুসলমান, যারা স্বেচ্ছায় আল্লাহ্র আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে, যারা তার জীবনকে আল্লাহ্র নির্দেশিত আদেশ-নির্দেশ ও সীমানা মেনে চলবার প্রশ্নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদেরকে সালাতের সঙ্গে যাকাত আদায় করার আদেশ দেয়া হয়েছে। মানবিক মর্যাদাবোধকে আহত না করে এবং লোক দেখানো মনোভাবকে পরিহার করে যাকাত, ফিতরা, দান, ইসলামী পরিভাষায় যাকে এক কথায় সদাকা বলা হয়েছে তা সংগ্রহ করে একটা ফা-ে জমা করতে বলা হয়েছে এবং সেখান থেকে অভাবী মানুষদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করার ব্যবস্থা গড়ে তোলার নজির আল্লাহর রাসূল ও তার সাথীগণ স্থাপন করে গেছেন। ইসলামের উন্মেষ যুগে এ রকম অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারটি সত্যিই বিস্ময়কর। জাহেলিয়া যুগে আরবদের লুণ্ঠনবৃত্তি ছিল শ্রেষ্ঠ পেশা। সেই আরবরা বায়তুল মালের ধারণা পেল কোথা থেকে? সেখানে দুই ধরনের মালিকানা ছিল। পানির উৎস ছিল সাধারণ সম্পত্তি। তাই কূপ থেকে সবাই পানি নিতে পারতো। কিন্তু খেজুরের বাগান ছিল ব্যক্তি মালিকানায়। এর মধ্যে অভাবী মানুষের সম্মান অক্ষুন্ন রেখে তাদের আর্থিক সাহায্যদানের জন্য বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা অর্থনীতির ইতিহাস আলোচনায় আসা উচিত ছিল, কিন্তু আসে নাই। দরিদ্র মানুষের প্রতি সদয় অর্থনীতিবিদ জন কেনিথ গলব্রেথ কিংবা অমর্ত্য সেন এ বিষয়ে কোন আলোকপাত করেন নাই। কেবল দরিদ্র মানুষের কথা বলাও সঠিক নয়, কারণ, খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর হযরত আবুবকর সিদ্দিককে তার ব্যক্তিগত কাপড়ের ব্যবসা ত্যাগ করতে বলা হয়। মদিনার জনপদে কাপড় বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা দৃষ্টিকটু বিধায় তার সহযোগীরা ব্যাপারটি সমর্থন করতে পারেন নাই। তাই তাদের পরামর্শে তাকে কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে বায়তুল মাল থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে সংসার চালাতে হয়। তার খিলাফতকালে রাসূল্লাহর রেখে যাওয়া ফাদাকের খেজুর বাগান রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। যুক্তি দেখানো হয়, রাসূলের উত্তরাধিকার তার উম্মত। রাসূলের মেয়ে হযরত ফাতিমা (রা.) খলিফার দরবারে এসে ফাদাকের বাগান অধিগ্রহণ করার প্রতিবাদ জানান। তিনি কোরআন থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে তার দাবি পেশ করেন। কিন্তু খলিফার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকে। বিষয়টি ফাতেমা-আলী পরিবারের জন্য মেনে নেওয়া কষ্টদায়ক হলেও জনস্বার্থে খলিফার এই অটল অবস্থান ছিল শিক্ষামূলক। ইসলাম এমন এক জীবনদৃষ্টি সৃষ্টি করে যা খলিফাদের শাসন ও জীবন ধারাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। তাদের জীবন ধারার মাহাত্ম্য বুঝতে সহায়ক হতে পারে বিবেচনা করে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করছি। একদিন খলিফা উমর তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে এই বলে অসিয়ত করছেন যে, “আমার মৃত্যু হলে আমি যে কাপড় পরিধান করি তাই দিয়ে আমার কাফন তৈরী করে আমাকে কবরে সমাহিত করো।” তার এই কথা শুনে তার স্ত্রী ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “এ আপনি কি বলছেন? অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা খলিফা উমর সমাহিত হবেন তার ব্যবহৃত পুরনো কাপড় দিয়ে তৈরী কাফন পরে!” জবাবে খলিফা বলেন, “নতুন কাপড় তো জীবিতদের বেশী দরকার। কবরে কে দেখবে আমাকে?” এই ছিল সেই ইসলামী জীবনদৃষ্টি। আজকের দিনেও আশার কথা যে শরণার্থী সমস্যার সমাধানে গঠন করা হয়েছে ‘ইউএন যাকাত ফান্ড’ এই ফান্ড লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বাঁচিয়ে রাখছে। আশার কথা যে, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র এই যাকাত ফান্ডে উদারভাবে সাহায্য করছে। সাম্প্রতিককালে সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং মায়ানমার প্রভৃতি দেশ থেকে হাজার হাজার, লাখ লাখ নর-নারী তাদের জীবন বাঁচাতে স্বদেশভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে আশা করা হয়েছিল শরণার্থীদের দুর্ভোগ দূর হবে দশ লাখ শরণার্থীর সমস্যা সমাধান