মোঃ সাহিদুল ইসলাম

একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবামার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয় মহান আল্লাহতায়ালাও শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা সম্মান দান করেছেনইসলাম মানুষকে জ্ঞানের পথে চলতে বলে, জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করেজ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে মূর্খতা ডেকে আনে পতনপরাজয় মানুষের আর্থসামাজিক অগ্রগতি নৈতিক বিকাশ অব্যাহত রাখতে সমাজে শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম

সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষকরা মানুষের ভেতর সত্যিকারের মানুষ সৃজন করেন। তাই শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা। জন্মদাতা পিতা শুধু জন্ম দিয়েই থাকেন, কিন্তু তাকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলেন তার শিক্ষক 

চাণক্য শ্লোকে রয়েছে, ‘শিক্ষককে কখনো অবহেলা করা উচিত নয় সৃষ্টি ধ্বংসের দুয়েরই বীজ লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষকের মধ্যে’ 

প্রকৃত মানুষ তৈরির মহান কারিগর শিক্ষকশিক্ষিকাদের মর্যাদা শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, শিক্ষকশিক্ষিকাদের মর্যাদা জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও সনদেও স্বীকৃত যারা শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত বা শিক্ষাদান করেন তাদের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও যৌথ উদ্যোগে শিক্ষকশিক্ষিকাদের মর্যাদাবিষয়ক সনদ তৈরি করেছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে ১৯৬৬ সালের অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই মর্যাদাবিষয়ক সনদটি গৃহীত হয়। 

ভবিষ্যৎ বংশধরদের যোগ্যদক্ষ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলোতে তাই বেতন সামাজিক অবস্থানে শিক্ষককে অনেক উপরে রাখা হয়কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থা তার উলটো দেশের শিক্ষকরা সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত বঞ্চিতশিক্ষকদের বেতনভাতা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও মর্যাদায় এগোচ্ছে নাশিক্ষকের মর্যাদা যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা কেবল মুখে আর বই পুস্তকেবিভিন্ন জায়গায় এখন শিক্ষকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন।আমাদের ভাবতে হবে যে, জাতির মেরুদণ্ডের চালিকাশক্তিকে বঞ্চিত করে, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করে, রাষ্ট্রের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা যাবে নাআমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে দিলে তারা লিখবে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার কেউ ‘শিক্ষক’ লিখবে না। যদিও দুই একজন লিখে ফেলে, আমি নিশ্চিত সে না বুঝে লিখে ফেলেছে। যেদিন সকল শিক্ষার্থী তাদের জীবনের প্রথম লক্ষ্য স্থির করবে ‘শিক্ষক’ সেদিন বুঝতে হবে দেশে পরিবর্তন এসেছে।আর এমনটি হলে দেশও পরিবর্তন হবে আশা করা যায়। 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতনকাঠামোর কথা বলা হলেও তা গত ১১ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুলকলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন আছে৷ সব কমিটিতে শিক্ষানুরাগীদের ঠাঁই নেই৷ কমিটিগুলো পুরোপুরি স্থানীয় সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে৷  

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কামিটিতে এখন আর শিক্ষানুরাগী পাওয়া যাবে না, কারণ, শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তিবাণিজ্য আর উন্নয়নমূলক কাজে এখন অনেক টাকা৷ সেই টাকার লোভে কমিটিগুলো দখল করেছে রাজনৈতিক নেতা প্রভাবশালীরা৷

তিনি বলেন, ‘‘ সব কমিটি শিক্ষার উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে না৷ উল্টো তারা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে অর্থ আয় করে৷

তিনি বলেন, ‘‘এই অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যাতে শিক্ষানুরাগীরা থাকতে পারেন সেজন্য সরকারের নীতিমালা করে দেয়া উচিত৷ ভোট হতে পারে, তবে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা বেঁধে দিতে হবে৷

আমার মতে, শিক্ষকতা এমন একটা পেশা, যেখানে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। সেই শিক্ষকদের যে পরিচালনা পরিষদ, বিশেষ করে পরিচালনা পরিষদের সভাপতি যদি কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হন তাহলে তাদের দ্বারা শিক্ষকরা আপমানিত/অসম্মানিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক (সব সভাপতি নয়)। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও সভাপতি হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতার নীতিমালা থাকা জরুরী।তাছাড়া, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা যদি বি, এ পাশ হয়, তাহলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা কেন নির্ধারিত হবে না? 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক . নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা এক ধরণের সামাজিক সঙ্কটের মধ্যে আছি৷ শিক্ষকের মর্যাদার ঐতিহ্যবাহী ধারণা বদলে গেছে৷ এর প্রধান কারণ শিক্ষার নিয়ন্ত্রক এখন আর শিক্ষাবিদরা নন৷ এর নিয়ন্ত্রণ এখন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রীএমপিদের হাতে৷ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও শিক্ষকদের অপমানজনক কথা বলা হয়, যার প্রভাব পড়ে সার্বিকভাবে৷

তিনি আরো বলেন, ‘‘শিক্ষকের মর্যাদা শুধু সামাজিক মর্যাদার ওপর নির্ভরশীল নয়, আর্থিক বিষয়টিও গুররুত্বপুর্ণ৷ এখন দুই দিক থেকেই তাঁরা অমর্যাদার শিকার৷

অনেকের ধারণা, শিক্ষকতা একটি সহজ পেশা আসলে এটি সবচেয়ে কঠিন একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবেন, তার প্রস্তুতি নিতে হয়; ছাত্রদের সম্পর্কে চিন্তা, গবেষণা লেখালেখি করতে হয় অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদেরও চাহিদা বাড়ছে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষকদেরও আপডেট থাকতে হবে শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে বিসর্জন দিতে হয় অনেক সময় দেখা যায়,  যেসব বিষয় শিক্ষার্থীরা বাসায় কিছু বলতে পারে না, সেগুলো অকপটে শিক্ষকের কাছে বলতে পারে সে কারণে ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক মধুর হওয়া দরকার আমরা যতই বলি, শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক ভালো না হলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হবে না, ছাত্ররা প্রকৃত শিক্ষা পাবে না একজন শিক্ষক ছাত্রের গাইড সুতরাং তাকে সেভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে ছাত্ররা যেন বোঝে :মাবাবার পরেই শিক্ষকের স্থান শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হয় তাই শিক্ষকের উচিত নিজের গুণাবলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া তাদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যা নেতিবাচক

শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের রোল মডেল বা আদর্শ পথপ্রদর্শক একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের জীবন আমূল বদলে দিতে পারেন তাদের নবজন্ম দিতে পারেন শিক্ষকদের অতুলনীয় অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১৯৯৪ সাল থেকে অক্টোবর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিতশিক্ষকদের মর্যাদাশীর্ষক সম্মেলনে গৃহীত এবং ইউনেস্কো আইএলও কর্তৃক স্বাক্ষরিত সুপারিশমালায় শিক্ষক দিবস পালনের জন্য অক্টোবর তারিখটি নির্ধারিত হয় দিনটি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিন; তাদের অবদানকে স্মরণ করার দিন জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৩ দেশের মধ্যে শতাধিক দেশ বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে

আমাদের দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের গড়ার উত্তম জায়গা হলো স্কুল সেখানে যোগ্য শিক্ষক নেই বললেই চলে অনেক দেশে সবচেয়ে ভালো ফলধারীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন এর কারণও আছে শিক্ষকরা সেখানে অনেক সম্মানী পান শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি সামাজিক অবস্থান বাড়ানো না গেলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না

স্কুল শিক্ষকদের কথা আমার এখনও মনে আছে উনারা আমাদের শুধু পড়াতেন না; শেখাতেনও আর এখন শুধু পড়ানো হয়, শেখানো নয় শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে আর্থিক অসচ্ছলতাও খানিকটা দায়ী শিক্ষকতাকে শুধু মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না, বরং তা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে তাদের বেতনভাতা অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন আজ আমরা মানসম্মত শিক্ষার কথা বলছি জন্য সর্বাগ্রে দরকার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক আর সব পর্যায়ে মেধাবী যোগ্য শিক্ষক পেতে পেশার সুযোগসুবিধা বাড়ানো জরুরিশিক্ষক যদি ভালো না হয়, তাহলে ভালো নাগরিক তৈরী হবে না। আর ভালো নাগরিক না হলে দেশও ভালো হতে পারে না।তাই, দেশকে ভালো করতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, মেধাবীদের এই পেশায় নিয়ে আসতে হবে। আর তার জন্য শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি ও মূল্যায়নের প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, সুশিক্ষিত হতে হবে।  

লেখকঃ বার্তা সম্পাদক, ডেইলি ট্রাইবুনাল, ই-মেইলঃ sahidnn@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here