এদিকে শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কথার রেশ যেতে না যেতেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বাজারে তেল ও চিনির দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তা বেশি দামে বিক্রি করছে।’ (সমকাল, ১৬ মে ২০২৩)। প্রকারান্তরে তিনিও বাজার সিন্ডিকেটের কাছে সরকারের অসহায়ত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।
সরকারের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বক্তব্য-মন্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে– সর্বক্ষেত্রে সিন্ডিকেটবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। তবে শুধু বাজার বা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়; প্রশাসন থেকে শুরু করে ফুটপাতের খুচরা ব্যবসায় পর্যন্ত সিন্ডিকেটবাজদের থাবা।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রাজধানীর বঙ্গবাজার এলাকার পানির ব্যবসা দখলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। খবরমতে, ১৩ মে ওই হল শাখা ছাত্রলীগের ৭০-৮০ জন নেতাকর্মী বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের সামনে শতাধিক পানির জার ফেলে রেখে সারাদিন অবস্থান নেয়। এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলর (১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ড, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ) সৈয়দা রোকসানা চামেলী ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পানিবাহী একটি গাড়ি ভাঙচুরও করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
এভাবে দেশের সর্বত্র সিন্ডিকেট দাঁড়িয়ে গেছে। দেশের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে সিন্ডিকেট সক্রিয় নয়। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে গেলেও সিন্ডিকেটের দ্বারস্থ হতে হয়। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গেলে তাদের কাছেই যেতে হয়। ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় নিজের জমির ওপর ভবন নির্মাণ করতে গেলেও স্থানীয় সিন্ডিকেটের সাহায্য (?) নিতে হয়।
তবে সিন্ডিকেটবাজির সবচেয়ে অসহায় শিকার মনে হয় এ দেশের কৃষক। উৎপাদিত ধান ইচ্ছামতো তারা বিক্রি করতে পারে না। যেতে হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। যাঁদের গ্রামবাংলার জীবন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁরা মাত্রই জানেন, এ দেশের কৃষক বছরে সাধারণত দু’বার ধান বিক্রি করে সংসারের খরচ নির্বাহ করে– একবার বৈশাখ মাসে, আরেকবার অগ্রহায়ণ মাসে। মাঝখানের সময়টা তারা বিভিন্ন ধরনের ধার-দেনা করে জীবন চালায়। আশা রাখে, বৈশাখ বা অগ্রহায়ণ মাসে ধান বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করবে। অবস্থাটা এমন, ওই সময়েই ধান বিক্রি না করে তাদের উপায় নেই। আর মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট গরিব কৃষকের অসহায়ত্বের সুযোগটাই গ্রহণ করে। তারা অপেক্ষাকৃত কম দামে ধান কিনে নিয়ে গঞ্জের বাজারের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে, যারা বিক্রি করে মিলারদের কাছে। মিলাররাই সেই ধান চাল করে বিক্রি করে সরকারের খাদ্যগুদামে। এ প্রক্রিয়ায় লাভবান হয় মহাজন-জোতদারের মতো দেশে গড়ে ওঠা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি।
এ কথা তো সবাই জানে, আমাদের দেশে শীতের সময়েই কৃষকরা বেশি সবজি চাষ করে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে একজন কৃষক যখন একটি ফুলকপি ১০ টাকা বা তার চেয়ে একটু কম বা বেশিতে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে; ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে সেগুলোই বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। একইভাবে একজন কৃষক প্রতি কেজি টমেটো বা শিম বিক্রি থেকে দাম পাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে সেটিই ঢাকা বা অন্য শহরে এসে হয়ে যাচ্ছে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এমন করেই কৃষকের উৎপাদিত সবজি থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ঘরে তোলে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী তথা সিন্ডিকেট; পকেট কাটা যায় ভোক্তার। বঞ্চিত হয় কৃষক।
২০২০ সালের দিকে মিলারদের চাল প্রক্রিয়াকরণ থেকে আহরিত মুনাফা নিয়ে এক গবেষণা চালায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি)। ‘অ্যাভেইলেবিলিটি অ্যান্ড প্রাইস ভোলাটিলিটি অব রাইস ইন বাংলাদেশ: অ্যান ইন্টার-ইনস্টিটিউশনাল স্টাডি ইন ২০২০’ শীর্ষক এ গবেষণার ফলে দেখা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণে মিলারদের ভূমিকা প্রায় ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ভূমিকা যথাক্রমে ২৯ ও ১৭ শতাংশ। দুঃখজনক, ভোক্তা ও কৃষকদের ভূমিকা মাত্র ১০ শতাংশ। বাজারে এই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের সুবাদে মিলাররা সেখান থেকে অস্বাভাবিক মুনাফা তুলে নিতে পারছে। বিজ্ঞজনের ধারণা, একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণেই মিলারদের মধ্যে এক ধরনের বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ দেখা যায়। তার প্রমাণও ব্রির এ সমীক্ষায় দৃশ্যমান। যেহেতু কৃষকরা মৌসুমের শুরুতেই ধান বিক্রির চাপে থাকে, বাধ্য হয়েই তারা তাদের রক্ত-ঘামে উৎপাদিত ধান তুলে দেয় মিলার ও ফড়িয়াদের হাতে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে কৃষকরাই একমাত্র উৎপাদক, যারা তাদের নিজেদের ফসলের দাম নির্ধারণ করার অধিকার রাখে না। বাজার সিন্ডিকেটের কাছে তারা এমনই অসহায়।
শুধু বাজার আর অর্থনীতিই নয়; রাজনীতির ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কম নয়। শোনা যায়, নির্বাচন এলে কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে, কাকে মন্ত্রী বানাতে হবে– এসবও নাকি নির্ধারণ করে বিশেষ সিন্ডিকেট। আসলে দেশ আজ এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে; সবকিছুই চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটবাজদের দখলে। এ অবস্থা দেশ বা সরকার কারও পক্ষেই যে মঙ্গলজনক নয়– তা বোঝার সময় কি এখনও আসেনি?
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক