মো: মোশারফ হোসাইন: পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই অন্ধকারকে ভয় পায় আর অন্ধকারকে ভয় পাওয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় লিক্টফবিয়া বলা হয়ে থাকে। অন্ধকার এমন একটি জিনিস যেটা আমাদের সম্পূর্ণ ইউনিভার্সে সকলের মনেই ছড়িয়ে আছে।

আমার ঘুমাতে গাঢ় অন্ধকারময় পরিবেশে লাগে। তা না হলে ঘুম আমার চোখে আসবেনা। তাই আমি সহজেই কোথাও ঘুমাতে পারি না। নতুন কোথাও গেলে কখনো প্রথমদিন ঘুম আসছে আমার চোখে এটা আমার জীবনে বিরল ঘটনা। তাই বলে আমি অন্ধকার ভালোবাসি কিংবা কম ভালোবাসি কোনোটাই পুরোপুরি ঠিক না।

আসলে কী অন্ধকার বলে কিছু আছে? উত্তর একদল বলবে নেই। অন্ধকার মানে আমাদের চোখে আলোর অনুপস্থিতি। তাই যেকোনো গাঢ় অন্ধকার সামান্য আলোর উপস্থিতিতে হারিয়ে যায়। আলোর অস্তিত্ব আছে এর কণা ও তরঙ্গ উভয় প্রকার ধর্মই রয়েছে। আলো এক প্রকার শক্তি। তাহলে অন্ধকার কী? আবারো একবাক্যে বলছি অন্ধকার হলো আলোর অনুপস্থিতি। যেমন সৃষ্টিকর্তার জগতে খারাপ বলে কিছু নেই, সব ভালো; আমরা যা খারাপ বলি তা হলো ভালোর অনুপস্থিতি।

ছাত্র জীবনে অন্ধকারে বসে বসে গান শুনতাম আর মনের কল্পনায় কত কল্প তরু অঙ্কন করতাম তার বলে শেষ করা যাবেনা।অন্ধকার নিয়ে আর কাব্যিক নয় এবার বৈজ্ঞানিক কথা বলব।

গবেষকদের মতে আমাদের এই পৃথিবীতে অন্ধকার বেশি। অন্ধকার তখনই বিলীন হয়ে যায় যখন আলো চলে আসে। আবার যখন আলো চলে যায় তখন ওই স্থানে অন্ধকার চলে আসে। তাহলে অন্ধকারের গতি কত? আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকে এটা জানা গেছে এই বিশ্বে এমন কিছু নেই যেটা আলোর গতিবেগ অতিক্রম করতে পারে। অর্থাৎ এই বিশ্বে কোনো কিছু সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার কিংবা এর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না। তাহলে অন্ধকারের গতি কত হতে পারে?

অন্ধকারের ভৌতিক রূপে কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্ধকার মানেই হচ্ছে আলো না হওয়া। অর্থাৎ আলোর অভাব। যখন আপনি আলোকে কোনোভাবে আড়াল করবেন তখন আপনি অন্ধকার পাবেন। যেটাকে আমরা ছায়া বলে থাকি। যদি আমরা গতির হিসেবে কথা বলি তাহলে অন্ধকার ওইটাই যেটা আলো আসা বন্ধ হয়ে গেলে পাওয়া যায়। যদি আমাদের সূর্য হঠাৎ করে আলো প্রদান করা বন্ধ করে দেয় তাহলে পৃথিবীতে আলো আসা বন্ধ হয়ে যাবে আর পৃথিবীতে অন্ধকার ছেয়ে যাবে। কিন্তু পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় লাগে। এর মানে সূর্যের আলোর ছোট থেকে ছোট অংশকে গায়েব হয়ে যাওয়ার জন্য আট মিনিট উনিশ সেকেন্ড সময় লাগবে। এরপর আলোর ছোট থেকে ছোট অংশ যাওয়ার পরে অন্ধকারকে পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড লাগবে। এর মানে আমরা পৃথিবীতে সূর্যকে আট মিনিট উনিশ সেকেন্ড পর্যন্ত দেখতে পারবো না।

অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন অন্ধকারের কোন গতি নেই সেটা না নড়াচড়া করতে পারে, না স্থানান্তর হতে পারে। যদি আমরা অন্ধকারকে আলোর অভাব ভাবি আর আলো নিয়ে অন্ধকারের পেছনে ছুটি তাহলে অন্ধকার ততটা গতিতে বিলীন হয়ে যাবে ঠিক যতটা গতিতে আলো আসবে। কিন্তু এর মানে এটাই দাঁড়ালো যে অন্ধকারও আলোর গতিতে ভ্রমন করতে পারে।

যখন কোন বস্তুর ওপর থেকে আলোর কোনো কণা প্রতিফলিত হয়ে আসে আমাদের চোখে আঘাত করে তখনই আমরা সেটাকে দেখতে পাই। আমাদের চোখে যে আলো এসে পড়ে সেতা ইউনিভার্সে থাকা বিশাল একটি ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের ক্ষুদ্রতম অংশ। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন এর মধ্যে অনেক রকমের আলো আছে। এই রেডিয়েশন খুব মারাত্মক তবে এর কল্যাণকর ব্যবহার ও রয়েছে। আমরা জানি আলো একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলাফেরা করে। আর এই গতির কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ প্যাটার্ন আছে। আমরা সব কিছু দেখতে পাই না।বিজ্ঞান বলে আমাদের চোখে এই ইউনিভার্সের বিশাল রেডিয়েশনের নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশকেই দেখতে পারে। অর্থাৎ আমাদের দেখার সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি।

এটাকে বোঝার জন্য কিছু উদাহরণ নেয়া যেতে পারে। যেমন, মনে করুন আমরা একটি পাখিকে যেভাবে অনেক রঙের সমন্বয়ে রঙ্গিন দেখি, একটি বিড়াল কিন্তু এইভাবে দেখেনা। কারণ ওই বিড়ালের ওই ধরনের কোষ নেই যেগুলো আমাদের আছে। এর মানে আমরা মানুষ এই পৃথিবীতে যে বিভিন্ন ধরনের রঙ দেখে থাকি তা শুধু আমাদের নিজেদের চোখ এবং মস্তিষ্কের তৈরি করা। সেটা আমাদের পৃথিবীর অন্য সব প্রাণীদের থেকে আলাদা। কিন্তু আমরা যে জিনিসটা পারি না বিড়াল কিন্তু সেটা খুব সহজেই পারে আর সেটা হল অন্ধকারেও দেখতে পারে। এর মানে বিড়ালের ভিতরে অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার কোষ আছে যা আমাদের মধ্যে নেই। আমরা যখন কোন কিছুকে দেখার কথা বলি তখন সেটা হচ্ছে আমাদের চোখের ভার্চুয়াল ধারনা। মনে করুন সূর্যের আলো যখন কার ওপরে পড়ে সে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখের মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়। সেই প্রতিবিম্বগুলোকে আমাদের চোখ আমাদের মস্তিষ্কে থাকা নিউরন কোষকে ট্র্যান্সফার করে তারপর মস্তিষ্ক আমাদের বলে দেয় আমরা কি দেখছি।

এই আলোর আরো কিছু বিষয় আছে, আলো বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে চলাফেরা করে। একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের আলোকেই আমরা শুধু দেখতে পারি। বাকিগুলোকে আমরা মোটেও দেখতে পাই না। যেমন এক্স রে, আল্ট্রাভাইওলেট রস্মি, গামা-রে এ রকম অনেক রকমের আলোকরশ্মি আছে যা আমাদের এই সাধারণ চোখ দেখতে পারে না। যেমন, আমরা মানুষের শরীরের ভেতরে থাকা হাড়কে খালি চোখে দেখতে পাই না কিন্তু যদি আমাদের চোখ এক্সরে সংবেদনশীল হতো তাহলে আমরা ঠিকই দেখতে পারতাম।

আমাদের মধ্যে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এই পৃথিবীতে আমরা যা দেখি তার বাইরে আর কিছুই নেই। কিন্তু বিজ্ঞানিকভাবে আমাদের এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। এখন যদি কোনো প্রাণী বা বস্তুকে শুধুমাত্র এক্স রে ওয়েভের মাধ্যমে দেখা যায় তাহলে সেটা আমাদের এই সাধারন চোখ ধরতে পারবে না। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে সেই বস্তু বা প্রাণীটি নেই। এই ক্ষেত্রে আপনি যদি বলেন ভূত আত্মা বা জিনের কথা, যে এদেরও তো খালি চোখে দেখা যায় না। তাহলে বলা যেতে পারে, হয়তো বা তবে নিশ্চিত হবে ধরা যেতে পারে এই মহাবিশ্বে এই রকম অনেক কিছুই আছে যেগুলো আমাদের এই সাধারন চোখ দেখতে পায় না। এই ঘটনা অবশ্যই আপনাকে ধর্ম বিশ্বাসকে দৃঢ় করবে।

বিজ্ঞানিরা এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা করছেন যেন আমাদের দৃষ্টিসীমার আরো বিস্তার হতে পারে। তাহলে এটা বুঝতেই পারছি এই সম্পূর্ণ বিশ্বে অনেক কিছুই আছে যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। বিড়াল আলো এবং অন্ধকারে দেখতে পারে কিন্তু আমরা পারি না। এটা হচ্ছে আমাদের সীমাবদ্ধতা কিন্তু বিড়ালের কাছে এই সীমাবদ্ধতা নেই। এর জন্য তারা দিন এবং রাত উভয় সময় দেখতে পারে এবং তাদের কোনো প্রকার সমস্যাও হয় না। যে সমস্যাটি আমাদের আছে।

যদি আমরা রাতের বেলায় কোনো সমস্যা ছাড়া দেখতে পারতাম তাহলে আমরা কি বলতাম অন্ধকার কে? হয়তো আমরা এটাই বলতাম যে, দিনের বেলাই আমরা বেশি দেখতে পারি আর রাতে একটু কম। আর যদি আমাদের চোখে রাতের বেলায় দেখতে পাওয়ার কোষ অনেক বেশি হত তাহলে হয়তো আমরা দিনের বেলাতেই কম দেখতে পারতাম আর রাতের বেলাতেই বেশি। এর মানে আমরা আজকের আলোচনা থেকে এটাই বুঝতে পারলাম যে, আমাদের এই সীমাবদ্ধতার কারণেই আমাদের সামনে অন্ধকার সৃষ্টি হয়।

লেখক: সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জয়পুরহাট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here