সাইফুদ্দীন আহমেদ
“গরিবের ডাক্তার”খ্যাত, সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব, ডাঃ সামসুর রহমান। আমৃত্যু প্রগতিবাদী এ মানুষটি তাঁর সময়ের চেয়ে চিন্তা, চেতনা, জ্ঞানে, দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিলেন অগ্রসর, প্রগতিমুখী।
নিজে যখন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বশেষ জ্ঞান আত্মস্থ করেই করেছেন। সুযোগ পেলেই বলতেন, “শোন, যে সময় ডাক্তারী পাশ করেছি, সেই সময়ের বিদ্যা ধরে চিকিৎসা করলে রোগী বাঁচবে নারে, রোগ বড় চতুর ও সময়ের সাথে তার চরিত্রও বদলায় “।
তিনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্যসহ নানা বিষয়ে প্রচুর পড়তেন। সমসাময়িক কালে তার মত পড়ুয়া মানুষ ছিল দুর্লভ। দেশ বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতেন সর্বশেষ মেডিকেল জার্ণাল, নানা বিষয়ের বই।
ডাক্তার সামসুর রহমান ওষুধ লিখতেন হিসেব করে। বাড়তি কোন ওষুধ তাঁর ব্যবস্থাপত্রে কখনোই থাকতো না। নির্ভুল চিকিৎসার জন্য নিজেই গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট প্যাথলজি ল্যাব। মানিকগঞ্জ শহরের প্রথম প্যাথলজি ল্যাব তাঁর হাতেই গড়া। নিজেই প্যাথলজিক্যাল টেস্টগুলো করতেন।
গরীব রোগীদের প্যাথলজি টেস্ট করতেন বিনা পয়সায়। শুধু প্যাথলজি টেস্টই নয়, দরিদ্র রোগীরা যার যা খুশি ফিস তাঁকে দিতেন। কে কত টাকা দিলো, না দিলো তা কখনও তাকিয়ে দেখতেন না। এমনও অহরহ ঘটেছে ফিস নেয়া দূরে থাক উল্টো ওষুধ কেনার টাকা পকেট থেকে দিয়ে এসেছেন। সুস্থ হলেন কিনা আগ বাড়িয়ে খোঁজ নিয়েছেন।
শুরুতেই বলেছি, তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রসর মানুষ। দেশে যখন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহনকে সমাজ পাপ বলে ভাবতো সে সময়ই তিনি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি নিয়ে ভেবেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেই সমমনাদের নিয়ে মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “জনসংখ্যা সিমীতকরণ সমিতি”।
এই সংগঠনটি মানিকগঞ্জের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কর্মসূচীর সফল অগ্রদূত।
প্রসঙ্গত চমকে দেয়ার মত একটি তথ্য বলতেই হচ্ছে,পাকিস্তান আমলে তিনি সেইসব প্রথম পুরুষদের একজন যিনি নিজে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহন করেছিলেন। সে সময়ে যা ছিল দুঃস্বপ্ন।
ডাক্তার হিসেবে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করিয়েছেন ২২ হাজার মানুষকে।
যা বাংলাদেশের একক কোন চিকিৎসকের গড়া রেকর্ড।
ডাঃ সামসুর রহমান ব্যক্তিজীবনে একজন সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। ৪০ দশকের শুরুতেই কলকাতার তৎকালীন ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজের( বর্তমানের এনআরসি মেডিকেল কলেজ) ছাত্র থাকাকালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিখ্যাত বাম নেতা কমরেড মুজাফ্ফর আহাম্মদের সাহচর্য লাভ করেন।
ডাক্তারী পাশের পর কলকাতার একাধিক হাসপাতালে চাকুরী করেছেন । এরপর চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন সরকারি চাকুরীতে। কিন্তু খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরকারি চাকুরী ছেড়ে দেন।
৪৭ এর দেশ ভাগের পর মানিকগঞ্জ শহরে স্থায়ীভাবে থেকে প্র্যাকটিস শুরু করাসহ বাম ধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন রাজনীতি, সাধারণ মানুষ আর সমাজসেবাকে।
পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে ডাঃ সামসুর রহমান ছিলেন সোচ্চার প্রতিবাদী মানুষ। পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রসৈসনিক হিসেবে মানিকগঞ্জের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছিলেন।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সৈনিক এ মানুষটি পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সহযোদ্ধাদের সাথে থেকে নির্মান করেছিলেন মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
তাঁর বাড়ির দরজা ছিল প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের জন্য অবারিত, তিনি ছিলেন তাঁদের দুঃসময়ের ঠিকানা,আশ্রয়।
সামসুর রহমান ১৯২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহন করেন। একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক, রাজনীতিক,
সমাজসংগঠক হিসেবে গণমানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৯৫ সালের ৩০আগস্ট পরলোকে গমন করেন। আজ তাঁর ২৬ তম প্রয়াণ বার্ষিকী। এই দিনে মহৎপ্রাণ মানুষটির প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here