মোঃ মোশারফ হোসাইন: আমরা সকলেই জানি যে, চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। এটি পৃথিবীকে একটি নির্দিষ্ট উপ-বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রতিনিয়ত প্রদক্ষিণ করে। ফলে পৃথিবী-চন্দ্র সমাহারের অবিরত পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীতে সংঘটিত জোয়ার-ভাটার সাথে এর আবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। আবার মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে চাঁদ ও পৃথিবী একে অপরকে আকর্ষণ করে। পৃথিবীর উপর চাঁদের এই আকর্ষণের প্রভাব দূরত্বের উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর যে পাশ চাঁদের দিকে থাকে সে পাশে চাঁদ থেকে দূরত্ব কম থাকায় আকর্ষণ বেশি থাকে, আর পৃথিবীর অপর পাশে চাঁদ থেকে দূরত্ব বেশি থাকায় আকর্ষণ কম থাকে। এই আকর্ষণই জোয়ার-ভাটার সাথে সম্পর্কিত।

সহজ কথায় জোয়ার ভাটা হলো পৃথিবীর বাইরের মহাকর্ষীয় শক্তির (বিশেষ করে চাঁদের) প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি ফুলে ওঠাকে জোয়ার ও নেমে যাওয়ার ঘটনাকে ভাঁটা (একত্রে জোয়ার-ভাটা) বলা হয়।

জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির কারণ: জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির প্রধান কারণ হল- সূর্য ও প্রধানত চাঁদ দ্বারা পৃথিবীর ওপর প্রযুক্ত মহাকর্ষ বল। পৃথিবীর ওপর কার্যকরী অভিকেন্দ্র বল। পৃথিবীর যে পাশে চাঁদ থাকে সে পাশে চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠের সমুদ্রের পানি তার নিচের মাটি অপেক্ষা বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। এ কারণে চাঁদের দিকে অবস্থিত পানি বেশি ফুলে উঠে। একই সময়ে পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে, সেদিকের সমুদ্রের নিচের মাটি তার উপরের পানি অপেক্ষা চাঁদ কর্তৃক বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। আবার চাঁদ থেকে পানির দূরত্ব মাটি অপেক্ষা বেশি থাকায় পানির উপর চাঁদের আকর্ষণ কম থাকে। ফলে সেখানকার পানি চারিদিকে ছাপিয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ফুলে উঠার কাহিনীটিই ঘটে। ফলে একই সময়ে চাঁদের দিকে এবং চাঁদের বিপরীত দিকে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির এই ফুলে উঠাকে জোয়ার বলে।

আবার পৃথিবী ও চাঁদের ঘুর্ণনের কারণে চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে গেলে ফুলে ওঠা পানি নেমে যায়। পানির এই নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে। পৃথিবী যে সময়ের মধ্যে নিজ অক্ষের চারদিকে একবার আবর্তন করে (এক দিনে) সে সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যেকোন অংশ একবার চাঁদের দিকে থাকে এবং একবার চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে। এ কারণে পৃথিবীর যেকোন স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়।

জোয়ার-ভাটার জন্য সূর্যের আকর্ষণও অনেকাংশে দায়ী। তবে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের থেকে কম কার্যকর। সূর্য এবং চাঁদ যখন সমসূত্রে পৃথিবীর একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন উভয়ের আকর্ষণে সর্বাপেক্ষা উঃচু জোয়ার হয়, জোয়ারের পানি বেশি ছাপিয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে ভরা কাটাল বা উঁচু জোয়ার বলা হয়। আর পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য এবং চাঁদের মধ্য কৌণিক দূরত্ব যখন এক সমকোণ পরিমাণ হয় তখন একের আকর্ষণ অন্যের আকর্ষণ দ্বারা প্রশমিত হয়। তাই সবচেয়ে নিচু জোয়ার হয় যাকে মরা কাটাল বলে আখ্যায়িত করা হয়। জোয়ার বলতে আমরা শুধুমাত্র সমুদ্রের পানির স্ফীতিকেই বুঝি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাঁদ-সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবীর স্থলভাগেও অনুরুপ প্রভাবের সৃষ্টি হয়।

মুখ্য জোয়ার: চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে আবর্তনকালে পৃথিবীর যে অংশ চন্দ্রের নিকটবর্তী হয়, সেখানে চন্দ্রের আকর্ষন সর্বাপেক্ষা বেশি হয়। এ আকর্ষনে চারদিক হতে পানি এসে চন্দ্রের দিকে ফুলে ওঠে এবং জোয়ার হয়। এরুপে সৃষ্ট জোয়ারকে মুখ্য জোয়ার বা প্রত্যক্ষ জোয়ার বলা হয়।

গৌণ জোয়ার: চন্দ্র পৃথিবীর যে পার্শ্বে আকর্ষণ করে তার বিপরীত দিকের জলরাশির ওপর মহাকর্ষণ শুক্তির প্রভাব কমে যায় এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তির সৃষ্টি হয়। এতে চারদিক হতে পানি ঐ স্থানে এসে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এভাবে চন্দ্রের বিপরীত দিকে যে জোয়ার হয় তাকে গৌণ জোয়ার বা পরোক্ষ জোয়ার

ভরা কোটাল: অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করলে অর্থাৎ সিজিগি অবস্থানে থাকলে, চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত বলের প্রবল আকর্ষণে যে তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তাকে তেজ কটাল বা ভরা কোটাল বা ভরা জোয়ার বলে।

মরা কোটাল: কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে পরস্পর সমকোণে থাকলে চাঁদের আকর্ষণে যেদিকে জলরাশি ফুলে ওঠে ঠিক তার সমকোণে সূর্যের আকর্ষণেও সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে। চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বল পরস্পর বিপরীতে কাজ করায় সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশি বিশেষ ফুলে ওঠে না, এই ভাবে সৃষ্ট জোয়ারকে মরা কোটাল বা মরা জোয়ার বলে।

জোয়ার-ভাটার সময়ের ব্যবধান: কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট একটি সময়ে মুখ্য জোয়ার হওয়ার ১২ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট পরে সেখানে গৌণ জোয়ার হয় এবং মুখ্য জোয়ারের ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পর সেখানে আবার মুখ্য জোয়ার হয়।তাই প্রত্যেক স্থানে জোয়ারের ৬ ঘণ্টা ১৩ মিনিট পরে ভাটা হয়।

লেখক: সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জয়পুরহাট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here