শাহনাজ রহমতুল্লাহ

সৈয়দ তোসারফ হোসেন :

জননন্দিত কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ ছুটি নিলেন চিরদিনের জন্য। আমাদের গানের ভুবনকে মাতিয়ে রেখেছিলেন যে কজন স্বনামধন্য শিল্পী শাহনাজ ছিলেন তাদের মধ্যমণি।
১৯৫৩ সালের ২ জানুয়ারি পুরনো ঢাকার এক সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তাঁর পিতার নাম ছিল এম ফজলুল হক। মাতা আছিয়া হক ছিলেন রত্নপ্রসবিনী। তাঁর অগ্রজ আনোয়ার পারভেজ ছিলেন শিল্পী ও সুরকার এবং তার অপর অগ্রজ জাফর ইকবালও ছিলেন জনপ্রিয় গায়ক ও নায়ক। দু’জন গুণী ভাইয়ের স্নেহ ছায়ায় বেড়ে ওঠা শাহনাজও যে শিল্পী হিসেবে সুনাম কুড়াবেন, সেটা ছিল এক প্রকার অবধারিত। মাত্র ১১ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন শাহনাজ। এটা ১৯৬৩ সালের কথা। টেলিভিশনে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে। পাঠক মনে করবেন না যে, তিনি কেবল তার অগ্রজদের সাহচার্য ও পরিচর্যায় বড়মাপের শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। তার অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খান আতাউর রহমানের বিরাট অবদান ছিল। অবদান ছিল স্বনামধন্য গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের। প্রখ্যাত সুরকার আব্দুল লতিফ ও আলাউদ্দিন আলীর অবদানকেও অস্বীকার করা যাবে না।

শাহনাজ কেবল বাংলা গানের শিল্পী ছিলেন না। উর্দু গান ও গজলের শিল্পী হিসেবেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন উর্দু ছবির জনপ্রিয় প্লে-ব্যাক শিল্পী। তাঁর গাওয়া প্রতিটি গানই শ্রোতাদের হৃদয় ছুয়ে যেতো। গজল সম্রাট মেহদী হাসান তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই মহান শিল্পীর কাছে গজল ও ক্ল্যাসিকের ছাত্রী হিসেবে তালিম নিয়েছিলেন শাহনাজ। হেমন্ত মুখার্জীর একটা গান আছে যেখানে বলা হয়েছে একদিনে তোমাদের হেমন্ত তৈরী হয়নি। আসলে রাতারাতি কোন শিল্পী তৈরী হয় না। শাহনাজও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। সঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে সৃজনী বৈচিত্র্যে শাহনাজের কোন জুড়ি মেলা ভার। তাঁর দরদী কণ্ঠে গীত প্রতিটি সঙ্গীতই শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো।

২০১৭ সালের ১২ মে প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও-এ জননন্দিত এই কণ্ঠশিল্পীকে মানিক মিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিনম্র অভিনন্দন জানাতে গিয়ে অভিনন্দনপত্রে তাঁর গাওয়া যেসব জনপ্রিয় গানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল এখানে তার পুনরুল্লেখ নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিজ্ঞ পাঠকরাও সেসব জানেন, তবুও তাঁকে স্মরণ করতে গেলে কিছু গানের কথা এসে যায়। তাঁর কণ্ঠে গীত ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেনো কাঁদলে’, এরকম কিছু গান সমকালের গন্ডি পেরিয়ে মহাকালের সম্পদ হয়ে উঠেছে। বাংলা চলচ্চিত্রে গাওয়া তাঁর গানগুলি আজও অবিস্মরণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায়’ (পিচঢালা পথ), ‘আমি সাত সাগরের ওপার হতে তোমায় দেখেছি’ (কত যে মিনতি ছবিতে সহশিল্পীর সঙ্গে গাওয়া) আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও ভালবাসা জানিয়ে তাঁর গাওয়া, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা’ (আবার তোরা মানুষ হ) ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর সুরের যাদুতে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ কিংবা ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ — এসব দেশাত্মবোধক গান শাহনাজের কণ্ঠে কালজয়ী হয়ে ওঠে।

২০০৬ সালের গোটা মার্চ মাস ধরে পরিচালিত বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের এক জরিপে এ যাবতকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে ৪টি গানের শিল্পী নির্বাচিত হন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। বিবিসি শ্রোতাদের এ রায় তাঁর জন্য এক দুর্লভ প্রাপ্তি। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থা পুরস্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আমাদের লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোসলে ছিল না কিন্তু ফিরোজা, শাহনাজ, রুনা, সাবিনা প্রমুখ ছিল। ফিরোজা আগেই চলে গেছেন, শাহনাজও চলে গেলেন। তাঁদের শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। এমনিতে আমাদের চলচ্চিত্র দাঁড়াতে পারছে না। সে কারণে গানের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো বেশিরভাগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। শিল্পীদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মতো সঙ্গতি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর নেই। প্রবাসী বাংলাদেশীরা মাঝে-মধ্যে তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এটা থেকে তাঁরা কিছুটা প্রণোদনা পাচ্ছেন। তবে একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল না থাকলে শিল্পী তৈরী হয় না। এদিকে আমরা তেমন নজর দিচ্ছি না। খেলা-ধূলার তুলনায় সংস্কৃতি চর্চা যথেষ্ট উপেক্ষিত হচ্ছে। শাহনাজকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমরা যেন এ বাস্তবতার কথা ভুলে না যাই।

লেখক: সম্পাদক ,-রোববার , সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here