মনিরা শরমিন

খুব ছোট আমি। আমাদের ভীষণ সাদামাটা আটপৌরে মধ্যবিত্ত বাসার ড্রয়িং রুমের টিভিতে সাদাকালো একটি ছবি চলছে। সপরিবার দেখছি আমরা। আব্বু, আম্মু, ছোট বোন, দুই মামা, বাসার গৃহকর্মী আর আমি। ছবি চলার সময় মাঝেমধ্যে আব্বু হাততালি দিয়ে উঠছে। আম্মু হন্তদন্ত মুড়ি মাখিয়ে এনে আবার তার নির্ধারিত বেতের চেয়ারে বসছে। মামারা কখনো হাঁটছে, কখনো হাসছে, কখনো গম্ভীর হচ্ছে। বিকেলের খেলা বাদ দিয়ে আমিও দেখছি। সাদাকালো ছবিটা আমার ভালো লাগছে। ভালো লাগছে সবার উপস্থিতি আর একত্রে থাকার উষ্ণতাটুকু। ছবি শেষ হলো। আব্বু মাথা নেড়ে রায় দিল, খুব ভালো ছবি, খুউব ভালো ছবি। ছবিটি ছিল জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। গণ–আন্দোলন আর গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে বানানো বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র।

ফলে জহির রায়হান যে ভালো ছবি বানান এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ যে একটি ভালো ছবি, এটি জানতে আমাকে চলচ্চিত্র উৎসব, বাঘা বাঘা চলচ্চিত্রের বই বা বিদ্যায়তনিক পরিসর পাড়ি দিতে হয়নি, বরং আমার খুব সাদামাটা পারিবারিক আবহের উষ্ণতম এক দিনে আমি জেনেছিলাম ছবিটি সম্পর্কে, চলচ্চিত্র থেকে অনেক দূরবর্তী কিছু মানুষের হাত ধরে।

এখানেই জহির রায়হান অনন্য। আন্তর্জাতিক থেকে শুরু করে আমজনতা পর্যন্ত তাঁর অবাধ বিচরণ। চলচ্চিত্রের কড়া সমালোচক থেকে খেটে খাওয়া মানুষ, শহুরে মধ্যবিত্ত থেকে গ্রামীণ সমাজ, মেলোড্রামা থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রামাণ্যচিত্র—সবকিছুতেই তাঁর অসাধারণ মুনশিয়ানা।

বাংলাদেশে আমরা যারা চলচ্চিত্রকে অল্পবিস্তর পাঠ করতে চাই, বোঝাপড়া সারতে চাই, তাদের জন্য জহির রায়হান পাঠ আবশ্যক। ফলে জহির রায়হানের সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার পরিচয় বাড়ছিল। তাঁর ‘কখনও আসেনি’ (১৯৬১) আর ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩) সার্বিক বিচারে অসাধারণ দুটি নির্মাণ। চলচ্চিত্র দুটিতে মজা হলো গতানুগতিক সম্পর্কের যে ধরন, তা ভেঙে ফেলার প্রবণতা। ‘কখনও আসেনি’ (১৯৬১) ছবিতে মারিয়ামের সঙ্গে সুলতানের সম্পর্কের ধরন বা নায়িকার সঙ্গে নায়ক শওকতসহ পরপর তিন চিত্রকরের প্রেমের সম্পর্ক যেভাবে মারিয়ামের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে চিত্রায়িত করেছে আজ থেকে ৫৯ বছর আগে, আজও তেমন আধুনিক নির্মাণ দেখা যায় না। শুধু তা–ই নয়, প্রথম ছবিতেই তিনি অ্যাগালম্যাটোফিলিয়ার (মূর্তির প্রতি আকাঙ্ক্ষা) মতো আনকোরা বিষয়ও হাজির করেছেন। সংগ্রহশালায় অসংখ্য নারীমূর্তি এবং মারিয়ামকে মূর্তি বানিয়ে রেখে তার প্রতিমূর্তি-সংগ্রহকারী সুলতানের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখি চলচ্চিত্রজুড়ে। পরবর্তীকালে একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন জহির রায়হানের খুব কাছের বন্ধু এবং সহচর আলমগীর কবীর তাঁর ‘সূর্য কন্যা’ (১৯৭৫) চলচ্চিত্রটিতেও।

আবার ‘কাঁচের দেয়াল’ শুধু নারীপ্রধান নয়, বরং এটি একটি নারীবাদী চলচ্চিত্রও বটে। এখানেও সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র হাসিনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান সেই বাড়িতে থাকা তার দূরসম্পর্কের মামাকে। ফলে হঠাৎই মামা ও ভাগনিকে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা হিসেবে আমরা দেখতে পাই। লটারিতে পাওয়া মৃত বাবার টাকা, হাসিনাকে বিত্তশালী করে তোলে। হাসিনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার সিদ্ধান্ত নেয়। বিত্তবান এই নারীর অনুগামী হয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে চাওয়া মামা। দুজন পাশাপাশি অনেকটা পথ হেঁটে গেলে যবনিকা পড়তে দেখি।

ফলে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’ (১৯৬৪); প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’ (১৯৬৫), প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’–এর (১৯৭১) নির্মাতা যেমন জহির রায়হান, ঠিক তেমনি এ কথাও নিঃসন্দেহে বলা চলে, পাকিস্তানের বাংলা ভাষায় নির্মিত প্রথম নারীবাদী ছবি ‘কাঁচের দেয়াল’–এর স্রষ্টাও তিনি। বলতে বাধা নেই, ১৯৬৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ (রায় নির্মিত নারীকেন্দ্রিক এবং নারীবাদী চলচ্চিত্র হিসেবে খ্যাত) মুক্তি পাওয়ার আরও আট মাস আগেই জহির রায়হানের ‘কাঁচের দেয়াল’ মুক্তি পেয়েছিল ওই একই বছরে। অবাক হওয়ার মতোই বিষয়, যে দুই বাংলার দুই কিংবদন্তি নির্মাতা প্রায় একই সময়ে এমন আধুনিক বিষয়বস্তু নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন।

বন্ধু ও সহযোদ্ধারা জানতেন জহির কমিউনিস্ট পার্টি করে, লেখা আর রাজনীতি দিয়ে দিনবদলের স্বপ্ন বোনেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বিপ্লবী দলের ‘কুরিয়ার’ আর দিনের আলোয় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা বিক্রি করা জহিরের মনে ৫২’র ভাষা আন্দোলন অভূতপূর্ব আলোড়ন তৈরি করেছিল। ‘আরেক ফাল্গুন’ (১৯৬৯), ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’সহ (১৯৭০) অনেক লেখনীতেই ছাপ পড়েছে ভাষা আন্দোলনের। ছোট ছোট বাক্যে সরল ভাষায় লিখতেন তিনি। সাংবাদিকতাও করেছেন অনেক দিন।

কিন্তু হঠাৎই চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে গেলেন। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’–এর (১৯৫৯) সহকারী হিসেবে কাজ করেই চলচ্চিত্র জগতের বৃহৎ পরিসরের অসংখ্য খুঁটিনাটি টেকনিক্যাল কাজ আয়ত্ত করে ফেললেন। শুধু কলম নয়, দিনবদলের কঠিন লড়াইয়ে যুক্ত হলো ক্যামেরাও। আগ্রহ, মেধা, পরিশ্রম এবং সততার অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল জহির রায়হানের মধ্যে। ফলে প্রথম চলচ্চিত্র থেকেই নতুন নতুন টেক্সট আর ভিন্ন স্বাদের গল্প নির্মাণ করেছেন তিনি। একটির সঙ্গে অন্য চলচ্চিত্রের স্টাইল ও গল্পে তাই কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
১৯৬৬ সালে পুরাণভিত্তিক ফোক ‘জনরার বেহুলা’ (আংশিক রঙিন) এবং পরের বছর সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭) নির্মাণ করেন। স্বাধীনতার আগে বেহুলা ছিল রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসাসফল ছবি। কিন্তু এই ছবির নির্মাণকে সমালোচকেরা জহির রায়হানের আপস হিসেবেই বিবৃত করেছেন। এসব নির্মাণ নিয়ে জহির রায়হানের বিপক্ষে অজস্র সমালোচনা থাকলেও তিনি প্রমাণ করেছেন, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন জনরায় তাঁর সাবলীলতা।

চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) নির্মাণের সময় কিউবার কমিউনিস্ট নির্মাতা স্যানটিয়াগো আলভারেজের প্রভাব দেখি। অনেকে ‘স্টপ জেনোসাইড’–এ ব্যবহৃত টেকনিককে আলভারেজ নির্মিত ‘হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিয়েম্প্রে’–এর (১৯৬৭) সঙ্গে তুলনা করেন। যেখানে কোনো ফুটেজই পূর্বপরিকল্পিত নয় বা নির্মিত নয়। এর সঙ্গে আলমগীর কবীরের ধারাবর্ণনায় নিজ আঙ্গিক যুক্ত করে দেন জহির। প্রতিটি বাক্যের শেষে টেলিগ্রাফের মতো ‘স্টপ’ বলা যেন আইয়ুব শাহিসহ আর দুনিয়ার তামাম শোষক, গণহত্যাকারীকে সাবধান করে দেওয়া, থামো; নয়তো পরিণতি ভালো হবে না। চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সময় মৃণাল সেনও সহায়তা করেছিলেন। নিজের এডিটিংয়ের কাজ থামিয়ে জায়গা দিয়েছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’–এর দলকে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জহির রায়হানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’, যেটি এখনো মুক্তি পায়নি। এই প্রামাণ্যচিত্রটিতেও আলভারেজের ‘নার্ভাস মন্টাজ’ (খুঁজে পাওয়া ভিডিও ক্লিপ, ছবি, পেইন্টিংসের ব্যবহার) টেকনিকের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

মাত্র ৩৭ বছরের জীবদ্দশায় জহির রায়হান আমূল পাল্টে দিয়েছিলেন দেশি চলচ্চিত্রের চালচিত্র। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ হতে পারত তাঁর আরেকটি মাইলফলক। পুরো স্ক্রিপ্টটা সাজানো ছিল তাঁর মাথায়। মাঝেমধ্যেই বলে উঠতেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ হবে আমার শেষ সিনেমা। সেই চলচ্চিত্র অর্ধেকেই রয়ে গেছে। ঠিক তাঁর চলচ্চিত্রে পরাধীনতার জাঁতাকলে আর শোষকের আগ্রাসনে অর্ধেক গাওয়া গান ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি’–এর মতোই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেও অর্ধেক রেখে জহির রায়হান হারিয়ে গেছেন তাঁর অর্ধেক জীবন নিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here