নিউজবাংলা ডেস্ক:

ভারতের উত্তরপ্রদেশের হাথরসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর চিকিৎসাধীন যে তরুণী প্রাণ হারিয়েছেন, রাজ্যটির পুলিশ পরিবারের সম্মতি ছাড়াই ওই তরুণীর মরদেহ রাতের আঁধারে গোপনে দাহ করেছে। অথচ ধর্ষণের ঘটনার পর পুলিশ এ সংক্রান্ত অভিযোগ নেয়ার ক্ষেত্রেও গড়িমসি করেছিল বলে অভিযোগ আছে।

ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, মাঝরাতে বাড়িতে ঢুকে তরুণীর মরদেহ নিয়ে যায় পুলিশ। আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীরা বাধা দিতে গেলে ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে রাখা হয় তাদের। এরপর তরুণীর বাবাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সেখান থেকে সোজা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে নির্যাতিতার মরদেহ দাহ করে ফেলা হয়।

কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর টানা ১৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে গতকাল মঙ্গলবার দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে মৃত্যু হয় দলিত পরিবারের ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণীর। এরপর হাসপাতাল থেকে মরদেহ পাওয়া নিয়েও পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধে পরিবারের।

নানা ঝামেলার পর অবশেষে রাত পৌনে ১১টার দিকে হাসপাতাল থেকে মরদেহটি ছেড়ে দেয়া হলে, তাদের কিছু না জানিয়েই পুলিশ মরদেহটি নিয়ে চলে যায় বলে অভিযোগ করেন মেয়েটির বাবা ও দাদা। হাসপাতালের বাইরে অবস্থান ধর্মঘটে বসেন তারা। পরে সেখান থেকে তাদের সঙ্গে নিয়ে হাথরসের উদ্দেশে রওনা দেয় পুলিশ।

মরদেহ হাথরসে পৌঁছালে মেয়েটির পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও গ্রামবাসীর পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করেন। সুবিচার না পাওয়া পর্যন্ত মরদেহ দাহ করবেন না বলে জানিয়ে দেন তারা। কিন্তু শুরুতে পিছু হটলেও রাতেই মরদেহ দাহ করতে হবে বলে নির্যাতিতার পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পুলিশ।

পুলিশের এমন জুলুমের প্রতিবাদ করেন তরুণীর পরিবারের লোকজন ও গ্রামবাসীরা। তারা এতে বাধা দিয়ে পুলিশকে জানিয়ে দেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় রীতি মেনেই মরদেহ দাহ করবেন তারা, তবে সেটা মাঝরাতে নয়। এরপরই পুলিশ তাদের ওপর জোর খাটাতে শুরু করে বলে অভিযোগ।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, নির্যাতিতার পরিবারকে এক পুলিশকর্মী বলছেন, ‘সময়ের সঙ্গে রীতি-নীতি বদলায়। তবে আপনারাও ভুল করেছেন। সেটা মেনে নিন।’

এরপরই নির্যাতিতার পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীদের তালাবদ্ধ করে রেখে, মরদেহটি নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশে রওয়ানা দেয় পুলিশ। তরুণীর বাবাকেও তোলা হয় গাড়িতে। রাত পৌনে ৩টা নাগাদ মরদেহ দাহ করে তারা। এ সময় শ্মশানের চারপাশের আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ।

ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেয়া সাক্ষাতকারে তরুণীর ভাই বলেন, ‘জোর করে আমার বোনের মরদেহ তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তারা আমার বাবাকেও শ্মশানে তুলে নিয়ে যায়। বোনের মরদেহ একবার বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতে চাই বলে পুলিশকে অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু আমাদের সেটাও করতে দেয়া হয়নি।’

অবশ্য উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। তাদের দাবি পরিবারের সম্মতিতেই নির্যাতিতার মরদেহ দাহ করা হয়েছে। কিন্তু তরুণীর মরদেহ দাহ করা নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কেন এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ভারতের এক কন্যাকে ধর্ষণ করে খুন করা হলো। সমস্ত তথ্য চেপে দেয়া হল, এমনকি মেয়ের সৎকারের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হল পরিবারের কাছ থেকে, যা অত্যন্ত অপমানজনক এবং অন্যায়।’

কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী লিখেছেন, ‘হাথরস নির্যাতিতা যখন মারা যান, তখন তার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল আমার। কান্না করছিলেন আর বলছিলেন, উনি শুধু মেয়ের জন্য সুবিচার চান। গতকাল রাতে শেষ বারের জন্য মেয়েকে বাড়িও নিয়ে যেতে পারনিনি তিনি। নিজ হাতে শেষকৃত্যও সম্পন্ন করতে পারেননি।’

উত্তরপ্রদেশের বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘যোগী আদিত্যনাথ পদত্যাগ করুন। নির্যাতিতা ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার বদলে, মৃত্যুর পরও তার মানবাধিকার কেড়ে নিতেও মদত দিয়েছে আপনার সরকার। মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার কোনও নৈতিক অধিকারই নেই আপনার।’

ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি লিখেছে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর একই গ্রামের চার যুবকের হাতে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হন ওই তরুণী। নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। প্রচণ্ড মারধরের পাশাপাশি শ্বাসরোধ করে খুনের চেষ্টা করা হয়। মুখের একাধিক জায়গা ও জিভ কামড়ের গভীর ক্ষতও করে দেয় তারা।

নির্মমভাবে ধর্ষণের শিকার তরুণীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তার দুই পা এবং একটি হাত ছিল অচেতন। মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শিরদাঁড়া ও ঘাড়। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু পরে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই মঙ্গলবার মৃত্যু হয় তার।

কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ার পরও পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক জেনেও তরুণীকে কেন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেলে সায়েন্সেসে (এইমস) ভর্তি করা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভীম আর্মির নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। দিল্লির সফদরজং হাসপাতালের বাইরে বিক্ষোভও দেখান ভীম আর্মির সদস্যরা।

তবে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের অভিযোগ, এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে কিছু লোক রাজনৈতিক সুবিধা নিতে নেমে পড়েছেন। তবে গোটা ঘটনায় শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন নির্যাতিতার পরিবারের লোকজনও।

তাদের অভিযোগ, অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ প্রথমে কোনও কথাই শুনতে চায়নি। দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা। ঘটনার চার-পাঁচ দিন পর তদন্ত শুরু করেছে।

অভিযুক্ত চারজন গ্রেফতার হয়েছে। বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে গঠন করা হয়েছে একটি দ্রুত বিচার আদালত। পরিবারের সম্মতি ছাড়া কেন মরদেহ তড়িঘড়ি দাহ করা হয়েছে তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। পুলিশের নেয়া এ ‘অমানবিক সিদ্ধান্তের’ ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন মানবাধিকার আন্দোলনকারীরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here