সিফাত আরা হুসেন 

সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটানো উপন্যাস “সংশপ্তক ” এর পরে আবারও অত্যধিক চরিত্রের উপস্থিতি সম্বলিত এখন পর্যন্ত যার উপন্যাস পড়েছি তিনি হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। “চিলেকোঠার সেপাই” এর পর তাঁর লেখা আমার পঠিত দ্বিতীয় উপন্যাস হলো “খোয়াবনামা। ”
“খোয়াবনামা ” একটি দীর্ঘ উপন্যাস। ছোট বড় চরিত্র মিলিয়ে পঞ্চাশের অধিক চরিত্রের সমাবেশ রয়েছে। এত এত চরিত্রের বৈচিত্র্য উপন্যাসের ভাববস্তুর প্রয়োজনে এত সুন্দর দক্ষতায় যে ফুটে উঠেছে সত্যিই তা অনবদ্য। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু অনুসারে কাহিনীর সময়কাল ১৯৪৬-১৯৪৭সাল এবং তার কিছু পরবর্তী সময়। আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে ১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অসাধারণ চিন্তাশীলতা দেখে যেখানে তিনি তাঁর শৈশবের সময়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও এ সংশ্লিষ্ট নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপট ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“খোয়াবনামা” উপন্যাসে রয়েছে তমিজ,তমিজের বাপ,কুলসুম, শরাফত মন্ডল, ফুলজান, আজিজ,কাদের,চেরাগ আলি,কেরামত আলি,কালাম মাঝিসহ উল্লেখযোগ্য ততোধিক চরিত্র। তেভাগা আন্দোলন এবং ভারতবর্ষ ভাগের বিভিন্ন দিকের সূক্ষ্ম চিত্রই উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে। তেভাগা শব্দটির অর্থ হচ্ছে উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ। বর্গা বা ভাগ চাষীরা উৎপাদিত ফসলের সমান আধাআধি ভাগ( দুই ভাগের এক ভাগ) পরিহার করে তিন ভাগের দুই ভাগ দাবী করে এবং এ নিয়ে ১৯৪৬-৪৭ সালে কৃষক সম্প্রদায়ের যে আন্দোলন সংঘটিত হয় তাই তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত। তমিজের পূর্বপুরুষ কাৎলাহার বিলের ধারে জংগল সাফ করে প্রথম চাষাবাদ শুরু করে গিরিরডাংগায়। তারপর কোন এক কালে ভূমিকম্পের দরুণ যমুনা নদীর গতিপথ পাল্টে বাংগালী নদীর সাথে মিশে গিয়ে আয়তনে বেড়ে উদরে দখল করে নেয় গোটা গ্রাম। সেই থেকে তমিজের বংশের পুরুষেরা হয়ে যায় মাঝি(জেলে)। তমিজের বাপের ছিলো চমৎকার জাল ফেলার দক্ষতা। তমিজের বংশ মাঝি হিসেবে গ্রামে বেশ সুপরিচিত হলেও তমিজের এতে কোন আগ্রহ নেই। তার স্বপ্ন একজন সফল চাষা হওয়ার। চাষবাসেও তার জুড়ি নেই। শরাফত মন্ডল, জমি কিনে কিনে জোতদার হবার যার নেশা,তারই ছোট ছেলে কাদেরের সাথে সখ্যতা করে তমিজ শরাফতের জমি বর্গা করার অনুমতি পায়। তার চাষে জমিতে ফসল ভালো ফলে কিন্তু শরাফত তাকে লাঙ্গল, গরু ইত্যাদির যোগান দেওয়ার অজুহাতে তাকে ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে। শরাফত মন্ডল হলো তেভাগা আন্দোলনের সময়কার ভূমিমালিকদের ভূমিকা পালনকারীরএকটি উৎকৃষ্ট প্রতীকী চরিত্র। তবে শরাফত মন্ডলের এহেন হিস্যা বন্টনে তমিজ দমে যায় না। বিভিন্ন জায়গায় চাষীদের তেভাগার কথা সে শুনেছে এবং এ আন্দোলন সফলের খোয়াবে মেতে শরাফত মন্ডলের কাছে নিজের বাড়ি সংলগ্ন জমিতে চাষবাস ও জোড়া গরু কেনার চিন্তা করে। নিজের অবস্থার উন্নতি, তার বাপ ও তার সমবয়সী সৎ মা কুলসুমসহ একই বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার খোয়াব ছিল তমিজের চোখমুখ জুড়ে। আর তার বাবা যাকে পরিচিত করানো হয়েছে পুরো উপন্যাসে তমিজের বাপ বলে কিছুটা রহস্যময় প্রকৃতির। কখনো কখনো ঘুমের ঘোরে এলোমেলো কথা বলে যা কুলসুম অনেক চেষ্টা করেও সে কথা স্পষ্ট করে শুনতে পায় না আবার কখনো কখনো সে ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলে কাৎলাহার বিলের ধারে। তমিজের বাপের একমাত্র আরাধ্য বা খোয়াব হচ্ছে পাকুড়গাছে বসে থেকে কাৎলাহার বিল শাসনকারী ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে ব্রিটিশদের গুলিতে নিহত ফকির মজনু শাহের সেনাপতি বা বৈকুন্ঠের ভাষ্যমতে ভবানীপাঠকের সহচর মুনশিকে দেখা। আর এ মুনশির সন্ধান করতে করতেই এক সময় তমিজের বাপ হারিয়ে যায় চোরাবালির অতল গহবরে। চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি কুলসুমের খোয়াব বড় অস্পষ্ট তবে তমিজের বাপের মৃত্যুর পর তমিজের বাপের ছায়ামূর্তি তার নিত্যকার জীবনযাপনে ছিল স্পষ্টতর। চেরাগ আলির রক্ষিত বই “খোয়াবনামা ” এর উত্তরাধিকারি ছিল তমিজের বাপ যা কুলসুম সযতনে রেখেছিল কিন্তু এক সময় কেরামত আলির কাছে সে তা হস্তান্তর করে যার প্রতি ছিল কেরামত আলির লোভ এবং সেই বইয়ের বদৌলতে নিজের অবস্থার উন্নতি করার খোয়াব কিন্তু কেরামত আলি নিজেও সেই বই গচ্ছিত রাখতে পারেনি। শরাফত মন্ডলের বড় ছেলে আজিজ সেই বই নিজের কাছে রেখে দেয় এবং তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সেই বইকে সুপ্রসন্ন নির্দেশক মনে করে। আশ্চর্যের বিষয় এই কুলসুম এবং তমিজের বাপ দুজনেই এই “খোয়াবনামা ” বেহাত হয়ে যাবার আঁচ পূর্বানুমান করতে পেরেছিল। তাইতো, কুলসুম বইটি বৈকুন্ঠকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বৈকুন্ঠ তা নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় জেদ করে কেরামত আলির হাতে দিয়ে দেয় এবং বইটি হাতে পাবার পর পরই কেরামত আলির মাথায় গানের কথা জমা হতে থাকে, আবার বইটি আজিজের দখলে চলে গেলে কেরামত আলির কলম শূন্য হয়ে পড়ে,জুতসই কিছুই রচনা করতে পারে না। তমিজের বাপ মারা যাবার পর কেরামত আলি কুলসুমকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে কুলসুম কেরামত আলির কাছে বইটি বিক্রি করে দেবার ব্যাপারে জানতে চায় এবং এ কথাও বলে তার মৃত দাদা চেরাগ আলি তার বাড়িতে এই বইয়ের সন্ধানে আসে। শরাফত মন্ডলের দাপটে কাৎলাহার বিলের এক ঝামেলায় তমিজকে জেলে যেতে হয়। এক বছর জেল খাটার পর তমিজ আবারও চাষবাসের স্বপ্ন দেখে ও হুরমতুল্লার মেয়ে ফুলজানকে বিয়ে করে। অথচ তমিজের চাষা কিংবা সংসারী হওয়া হয়ে উঠে না। শরাফত মন্ডলের পর কালাম মাঝির কাৎলাহার বিল ইজারা নেওয়ার পর আবারও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তমিজ আসামী হয় তবে তমিজকে আশ্রয় দেয় কাদের তার টাউনের আত্মীয় ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে। সময় গড়িয়ে যায়। কালাম মাঝি কুলসুমকে একা পেয়ে তার উপর হামলে পড়ে এবং কুলসুমের সাথে ধ্বস্তাধস্তিতে লিপ্ত হয়। কেরামত আলি কুলসুমকে বাঁচাতে গিয়ে বটি দিয়ে কালাম মাঝির কনুইতে আঘাত করে এবং দ্বিতীয় আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কুলসুমের বুকে বিদ্ধ হলে কুলসুমের মৃত্যু হয়।ফুলজানের গর্ভে বেড়ে উঠে তমিজের সন্তান এবং সে সন্তান অতি অল্প বয়সে অর্জন করে তমিজের বাপের অদৃশ্যের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলার দক্ষতা। আর তমিজ বড়লোকের বাড়িতে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচলেও পরবর্তীতে ছুটে চলে তেভাগা আন্দোলনের সন্ধানে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো যে তেভাগা আন্দোলন সফল করার কথা ছিল রাজনৈতিক ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দদের হাত ধরে তারাই নিজেদের স্বার্থে ভোটের মাঠে জয়ী হবার জন্য তমিজের জেল খাটাকে কেন্দ্র করে এবং তমিজকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাঝিপাড়ার ভোট আদায় করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। তমিজ এক বছর জেল খেটে মুক্তি পেলেও মাঝি সম্প্রদায় বা চাষাদের আন্দোলনের কোন ফললাভ হয়নি। তেভাগা নিয়ে একটা বিল পাস হবার কথা বলা হলেও পরবর্তীতে ঐ বিলে বর্গাদারদের কথা বাদ দেওয়া হয়। কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার আঁচ পূর্ববংগে ছড়িয়ে পড়ে এবং অবস্থাসম্পন্ন হিন্দুদের অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে বসতভিটা বিক্রি করে কলকাতায় চলে যায়। অনেক মুসলিমরা হিন্দুদের সম্পত্তি সস্তা দরে ক্রয় করে আবার অনেকে হিন্দুদের দেশত্যাগের ফলে তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট দখল করার পায়তারা করে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান হলে চাষা,জেলে,মজুর সবার অবস্থার উন্নতি হবে এবং জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হবে এমন ঘোষণা দিয়ে ইসলামি কায়দায় দেশ গড়ার নিমিত্তে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে প্রান্তিক জনপদকে একত্রিত করে নতুন রাষ্ট্র গঠন হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের অবস্থা থেকে যায় আগের মতোই।
ইসমাইল হোসেন কিংবা কাদের তমিজকে শেল্টার দিলেও তা শুধু নিজ স্বার্থে। তমিজকে নিমিত্ত করে ইসমাইল হোসেন ভোটের সময় তমিজকে জেল থেকে মুক্তি পাইয়ে দেবার ওয়াদা করে মাঝিপাড়ার সব ভোট আদায় করে। আবার, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইলেকশনে কাদের কালাম মাঝির বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য কালামের ইজারা নেওয়া কাৎলাহার বিল ডাকাতির এক নম্বর আসামী তমিজকে আশ্রয় দেয় ওই একই কায়দায় ইসমাইল হোসেনের মতো মাঝিপাড়ার ভোট আদায় করার জন্য। অথচ তমিজের মতো বর্গাচাষাদের তেভাগা নিয়ে ভোটের পরে তা আর আমলে নেওয়া হয় নি।
“খোয়াবনামা ” উপন্যাসে পোড়াদহ মেলার বর্ণনা অত্যন্ত চমৎকার। পড়তে পড়তে ইচ্ছে হয় একবার ওই মেলা ঘুরে দেখার। তাছাড়া, পান্তাভাত ও নানা রকম মাছের বর্ণনাও এসেছে কয়েক জায়গায় সুস্বাদু ভংগিতে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মাত্র দুটি উপন্যাস রচনা করেছেন এবং “খোয়াবনামা ” উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসের একটি বললে কখনোই অত্যুক্তি হবে না

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here