আজকের প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা বিপর্যয়ের মুখে

রাশেদা আক্তার 

একটি অমর অম্লান চিরবিভাময় আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষার মধ্যে দিয়ে সমগ্র জাতি ভাবতে শেখে বাঙালির জাতীয় সত্তা ও রাষ্ট্রীয় সত্তার কথা। আর বাঙালি হিসাবে বিশ্বের বুকে আমাদের স্বীকৃতি ও পরিচয়কে সুদৃঢ় করেছে মাতৃভাষা বাংলা ।

১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি কত নির্মম,অত্যাচার-অবিচারের বাঁকে বাঁকে সালাম -রফিক সহ অনেকে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে অক্ষত রেখেছিল।এই ভাষার মান রক্ষার জন্য তরুণরা বুক পেতে নিয়েছিলো পুলিশের গুলি। কিন্তু হৃদয় বিদগ্ধ পরিতাপের বিষয় সেই গৌরবদীপ্ত অহংকারের  ভাষা সংগ্রামী  বাঙালী চেতনাহীন,সংস্কৃতিহীন অভিভাবক ও তরুণ প্রজন্মের অবজ্ঞায় রক্তঝরা বাংলা ভাষা হারাচ্ছে তার যথাযোগ্য সম্মান। ভাবতেই অবাক লাগে এই ভাষার জন্য রাজপথে প্রতিবাদের রক্তিম ঝড় উঠেছিলো। রক্তে বাংলার রাজপথ  রঞ্জিত করেছিলো তরুণ প্রজন্ম বা শিক্ষার্থীরা। অথচ আজ ভাষা আন্দোলনের দশক পরের প্রজন্ম ও আমাদের শিক্ষিত সচেতন অভিভাবকরা ভাষার অবমাননা করছে প্রতি ক্ষেত্রে। আমাদের বাঙালি জাতির আত্মোপলব্ধির উত্তরণ ঘটে ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আজ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থার ক্রমবিকাশ ও অবাধ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে তরুণ প্রজন্মের অন্তরাত্নায় সৃষ্টি হয়ে এক নতুন বিশ্ব সংস্কৃতির ধারা। যা আমাদের প্রজন্মকে শেকড় থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে এবং বিচ্ছিন্ন করছে মৌলিক চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতি থেকে। ভাষা জড়িত থাকে জাতির অস্তিত্বের সাথে। আর যে জাতি বা প্রজন্ম তাঁর অস্তিত্ব মৌলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাকে খুব সহজেই উপড়ে ফেলা সম্ভব এবং ধ্বংস করা সম্ভব সংগ্রামী জাতীয় সংস্কৃতি ও স্বাধিকারকে।তাই তরুণ প্রজন্মের মাঝে মাতৃভাষা কেন্দ্রিক সাহিত্যের মননশীল চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। শহীদের ত্যাগ আর  মাতৃভাষা আন্দোলন বাঙালির ঋণ। ভালোবেসে মাতৃভাষা,ও বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি আর বিপ্লবী চেতনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছড়িয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত ভাষা আন্দোলনে প্রতিটি শহীদের প্রতি বাঙালির ঋণশোধ। [শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ]

বাংলা ভাষা ও বর্তমান প্রজন্মের উদাসীনতা

দিলুয়ারা বেগম 

“বাংলাভাষা” শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে মস্তিষ্কে এক নিরব হিল্লোল বয়ে যায়। সেটা বিশ্লেষণ করলে প্রকাশ হয়ে পড়ে সেই ভাষার জন্য লক্ষ শহীদের আত্মাহুতির বর্ণিল ইতিহাস। শত নক্ষত্রের ঝরা পড়া আর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন লাশের প্রতিকৃতি। কি ভয়ানক পরিস্থিতি!

কিন্তু আজ, সেই রক্তে কেনা ভাষার দাম দিতে আমাদের কার্পন্যতার সীমা নেই। বর্তমান প্রজন্মের মুখে প্রায়শই শোনা যায় “আমার বাংলাটা ঠিক আসে না”, এখানে স্পষ্ট যে, আমরা আমাদের মায়ের ভাষার সঠিক মুল্যায়ন করছিনা। বর্তমান প্রজন্মের কয়জন-ই বা শুদ্ধ সাবলীল বাংলায় কথা বলতে পারে? কথায় কথায় ইংরেজি মিশানো বর্তমান প্রজন্মের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এই ফ্যাশনের শিকড় এত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে ‘নয় বাংলা নয় ইংরেজি’র মতো হযবরল এক ভাষার আবির্ভাব ঘটিয়েছে এই প্রজন্ম। তার নামও দিয়েছে আবার বাংলিশ! এতে আমাদের বাংলা ভাষাকে যেমন অপমান করা হয়, তেমনি ইংরেজি কেও। আমরা যদি নিজের সন্তানকেই মানুষ করতে না পারলাম তাইলে অন্যের সন্তানের কি আর দেখাশোনা করবো? তাই আমাদের উচিত প্রথমত শুদ্ধ বাংলার চর্চা করা, এবং নিজের ভাষার উপর পূর্ণ দক্ষতা অর্জনের পর অন্য বিদেশী ভাষার চর্চা করা। কেননা নিজেকে আধুনিক বানাতে গিয়ে পাছে আমাদের ঐতিহ্য কে না কবর দিয়ে ফেলি। এই বাংলা ভাষা-ই আমাদেরকে বিশ্বের বুকে বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে। সুতরাং আমরা যেনো আমাদের বাঙালিত্বের আদর্শকে ধরে রাখতে পারি। বর্তমান প্রজন্ম যদি বাংলা বলাকে গেঁয়ো মনে করে তবে এটা নিশ্চিত যে তারা ইতিহাস ভুলতে বসেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর যে ধস নেমে আসবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।[শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহারে তরুণদের সচেতনতা

আয়শা সিদ্দিকা

এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে এখনো তরুণ প্রজন্ম সচেতন না।ইংরেজি ভাষায় কথা বলার চর্চা বাড়ছে।অনেকে ইংরেজি বলাকে স্মার্ট মনে করে।শুধু মূল্যবোধের অভাবে বাংলাভাষা তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। একটি দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের তার নিজস্ব ইতিহাস জানা প্রয়োজন।নিজের দেশের ভাষাকে সম্মান করতে  না পারলে সে অন্যে দেশের  ভাষাকে সম্মান করতে পারবে না।শ্রদ্ধা করতে পারবে না।ইতিহাস থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়।

তরুণ প্রজন্ম যদি আধুনিকতার নামে শিকড়কে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব ভাষা,সংস্কৃতির অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।সাবলীল ব্যবহারের মাধ্যদিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সদিচ্ছা আর সচেতনতাই পারে,বাঙালির এই গৌরবের ভাষাকে প্রজন্মে পর প্রজন্ম ঠিকিয়ে রাখতে।[শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

নাঈমা আক্তার রিতা 

যে কোন জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। সেই মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্য বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা রাজপথে নেমে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলো। ভাষার প্রতি এমন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

সেই মাতৃভাষা আজ নিজস্বতা হারাচ্ছে। একটি ছোট্ট শিশু “তুমি কোন শ্রেণিতে পড়ো?” প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি। অথচ “What class are you in?”  বলায় চট করে বলে উঠলো “I read in class play one.” শিশুটির মা হেসে উত্তর দিলো  “ও আসলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তো তাই।”  বাংলা ভাষার চরম দুরবস্থা এর মধ্যেই ফুটে উঠেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার চর্চা হয় দিবস কেন্দ্রিক। অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে আজকাল এতো বেশি ইংরেজি চর্চা হয় যে, মাতৃভাষা বাংলার স্থানটি দখল করতে ইংরেজির হয়তো বেশি দিন লাগবেনা।

তাই মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আজকের প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। বাংলাকে দিবস কেন্দ্রিক নয় বছরব্যাপী চর্চা করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বাংলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। [শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here