রামপ্রসাদ দীপু, মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জে এখন সরিষার ভরা মৌসুম। দিগন্ত বিস্তৃত হলুদের সমারোহ আমাদের মনকাড়ে। যতদুর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদের মাখামাখি। সরিষার বাম্পার ফলনে বরাবরের মতো এবারও ভালো মূল্য পাবে সেই স্বপ্নে বিভোর কৃষক। সরিষার পাপড়ির মতোই আনন্দে দুলছে তাদের মন। সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মৌমাছিরা। মধুর অন্যতম প্রধান উৎস সরিষার ফুল। মৌমাছির মতোই ব্যস্ত এখন মৌ-চাষীরা।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জের ৭টি উপজেলাতে চলতি মৌসুমে ৬০ থেকে ৭০ মে.টন মধু সরিষা ফুল থেকে সংগ্রহ করার লক্ষ নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে মৌ-চাষিরা। এক থেকে দেড় কোটি টাকার মধু বিক্রয় হবে বলে ধারণা করছে মৌচাষিরা। ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয়, সাটুরিয়া, সিংগাইর, হরিরামপুর,এলাকার বিভিন্ন স্থানে ৪ শতাধিক মৌয়ালরা সরিষা ক্ষেতে কাঠের বাক্সে মৌমাছি পালন করে মধু উৎপাদন মাঠে নেমেছে তারা।
মৌচাষিরা সকালে তাদের বাক্স থেকে মৌমাছি ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যার সময় দল বেধেঁ মৌমাছি মধু আহরণ করে আবার ফিরে আসে। মধু ভারত, মালেশিয়া,কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে এলাকার অনেক যুবক। বেকার যুবকদের অনেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে অর্থ, উদ্ভাবনী চিন্তা ও আত্মবিশ^াসকে কাজে লাগিয়ে সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন করছে তারা। মানিকগঞ্জে এবার ৩৬ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য ৪ শতাধিক মৌখামারী সরিষা ক্ষেতের আশে পাশে ৪ হাজার ৭৩৮টি বাক্স বসিয়েছেন। ফরিদপুর, যশোহর, গাজিপুর, পাবনা, নারায়নগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও খুলনা থেকে অনেক মৌচাষিরা মানিকগঞ্জের ৭টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মধু সংগ্রহের জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি নিয়েছে।
শুধু মধু সংগ্রহের পরে সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সঙ্গে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এসব এলাকাগুলোতে এখন সৌখিন ও প্রকৃতি প্রেমিরা বেড়াতে আসছেন প্রতিদিন। তারা অপরূপ সোন্দর্য ধরে রাখার জন্য তা ক্যামেরা বন্দি করছেন। যুবক যুবতি, কিশোর কিশোরি থেকে শুরু করে প্রকৃতিপ্রেমি সকল শ্রেণির এই অপরূপ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে । এছাড়া সরিষা চাষে অর্জিত হয় দ্বিগুণ লাভ। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য এর ফুল ও পাতা ঝরে জৈব সার তৈরি হয়। ফলে মানিকগঞ্জের ৭টি উপজেলার অনেক কৃষক ধানের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকে পরেছে। চলতি বছরে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সরিষা আবাদ করে অনেক কৃষক বেশি লাভবান হচ্ছে। মানিকগঞ্জে সরিষা ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো মাঠ । সরিষা ফুলের মনমাতানো গন্ধে সবাইবে আকৃষ্ট করে। মৌমাছি ফুলে ফুলে করছে পরাগায়ন। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছি পালনের কারণে ক্ষেতে কোন কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছেনা। ফসল তুলনামূলক ভালো হয়। এছাড়া ক্ষেতের পাশে বাক্সে মৌমাছি পালন করে মধু উৎপাদনও হচ্ছে নির্বিঘেœ। এ বছর পরিবেশ ও আবহাওয়া ভাল থাকায় সরিষা চাষ করে গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হবেন বলে কৃষকেরা ধারণা। তারা ভাল বীজ সনাক্ত করে সঠিক সময়ে রোপন করে। রোগ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ধরনের সারের পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগ করেছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আগাম ফলন ফলিয়ে তা বাজারজাত করতে পারলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অধিক লাভ করতে পারবে। এক বিঘা জমিতে চলতি মৌসুমে সরিষা আবাদে খরচ হয়ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। ফলন ভাল হলে প্রতি বিঘাতে চার থেকে পাঁচ মন সরিষা আবাদ হবে। বর্তমানে বিভিন্ন হাট বাজারে প্রতিমন সরিষা ১৮শ’ টাকা থেকে ২২শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের চেয়ে সরিষা অবাদ করলে লাভ দ্বিগুণ হয়। কাজেই সরিষা চাষে কৃষকেরা বেশি আগ্রহ থাকে। প্রতি বছর মৌচাষিরা নভেম্বর মাস থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য বেড়িয়ে পরে।
মৌচাষি হাবিবুর রহমান জানান, প্রতিদিন তাদের একটি খামারে প্রায় ১০ থেকে ১২ টন মধু আহরণ হয়। তাদের মধু স্কয়ার, বেক্সিমকোসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি হয়। তবে মানিকগঞ্জে গত বছরে প্রায় ৬০ মে. টন মধু আহরন করা হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর এলাকার মৌচাষী সিরাজুল ইসলাম জানান, আমরা মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলাতে তিন থেকে সাড়ে তিন শতাধিক খামারির প্রায় এক হাজার লোক এসেছি সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য। ঘিওর উপজেলাতে দেড় শতাধিক বাক্স বসিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে এক বার বাক্স থেকে মধু বের করা হয়। প্রতিটি বাক্স থেকে তিন চার কেজি মধু পাওয়া যায়। মানিকগঞ্জে দুই মাস মধু সংগ্রহের পরে তারা আবার গোপালগঞ্জ যাবে মধু সংগ্রহের জন্য। বছরে তারা ছয় মাস মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকেন। খুচরা প্রতি কেজি মধু তারা ২৫০ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। কোম্পানির কাছে তারা ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা কেজি মধু বিক্রি করেন। সরকার যদি মূল্য ঠিক করে দিতেন তাহলে মৌয়ালরা লাভবান হতেন। বাবুল নামের এক মৌচাষি জানান, সাতক্ষীরা থেকে অষ্ট্রেলিয়ান ম্যালেফিয়ান জাতের মৌমাছি বাক্স নিয়ে সদর উপজেলার মুলজান এলাকায় বিভিন্ন সরিষা ক্ষেতের পাশে বসিয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৫ হাজার টাকার খুচরা মধু বিক্রি করেছে। এ মৌসুমে তিনি ২ লাখ টাকার মধু বিক্রির আশা করছেন।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে সরিষা ফুল থেকে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। ফসলি জমিতে মধু আহরণে জমির কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। গত বছরে প্রায় ৬০ মে. টন মধু আহরণ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি টাকা । তবে চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here