নিউজবাংলা ডেস্ক:

পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে চঞ্চল ও শাওনের গাওয়া ‘যুবতী রাধে’ গান নিয়ে চলমান বিতর্কে চরম বিভ্রান্ত এর শিল্পী শাওন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে আজ শনিবার দুপুরে এমন মন্তব্যই করলেন তিনি।
জানা গেছে, আয়োজকদের কাছ থেকে গানটি গাওয়ার প্রস্তাব পেয়েই রাজি হন তিনি। কারণ, এ গানের প্রথম লাইন `সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই’–এ কথা ও সুর তাঁর সেই ছোটবেলা থেকে শোনা।

শাওন বললেন, ‘আমি শুক্লা সরকারের স্টুডেন্ট। ছোটবেলায় জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে এই গানে অনেক নেচেছি। কৃষ্ণ সেজে নাচতাম, তাই এই গানের কথা মনে আছে। ভেবেছি, ছোটবেলার সেই গানটা এবার গাইব। ইউটিউবে গানটা খুঁজতে গিয়ে ২৫-৩০টি ভার্সন পেলাম। প্রতিটা ভার্সনের কথা একটু এদিক-ওদিক। কিন্তু সুর একই। প্রতিটা ভার্সনের ক্রেডিট লাইনে লেখা, প্রচলিত গান, সংগৃহীত গান—কোথাও কোনো গীতিকার বা সুরকারের নাম লেখা নেই।

সেখানে আমার তো দৈবক্রমেও জানার উপায় নেই, গানটি কোন ব্যান্ড দল কপিরাইট নিয়েছে। আয়োজকের মধ্যে পার্থ বড়ুয়ার মতো একজন শিল্পী আছেন, তিনিও খুঁজে এমন কিছু পাননি।’

এরপর ‘যুবতী রাধে’ গানটি কণ্ঠে তোলার পালা। রেয়াজ করে কণ্ঠে তুললেন শাওন। গাইলেন। শুটিং করলেন। প্রকাশিত হলো। সবাই প্রশংসাও করতে লাগল চঞ্চল ও শাওনের গাওয়া এ গান। শাওন বললেন, ‘গানটা প্রকাশের কিছু সময় পর কপিরাইট ক্লেইম করে ইউটিউব থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো!

চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন

চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন

তখনই প্রথম জানলাম, গানটা সরলপুর নামের একটা ব্যান্ডের। এটা হয়তো আমার দীনতা, কারণ আমি দলটার নাম জানতাম না। তাঁদের দাবি, এই গান তাঁদের। কপিরাইট তাদের করা। তাঁরা দাবি করলেন, গানটা তাঁদের লেখা। ওটা জানার পরও শকড হলাম এটা ভেবে, কেন আগে থেকে জানলাম না। গান প্রকাশের কিছু সময় পর, সরলপুর ব্যান্ডের পুরোনো একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি। সেখানে তাঁরা বলেছেন, গানটা তাঁরা ২০০৮ সালে একজন বাউলসাধক এবং সাধন সঙ্গিনীর কাছ থেকে পেয়েছেন। সেটা শুনেও শকড হলাম। ফেসবুকে বিবৃতিতে দেখলাম, তাঁদের লেখা মৌলিক গান। অথচ ভিডিও ইন্টারভিউতে তাঁরা বললেন, ৩০ ভাগ বাউল সাধকের কাছ থেকে পেয়েছেন, ৭০ ভাগ তাঁদের লেখা! এরপর জানতে পারলাম, সুরও নাকি তাঁদের করা! আমি আরও বিভ্রান্ত। কোনো অনুযোগ-অভিযোগ করছি না। তাঁরা কী বলতে বা বোঝাতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না।’ইউটিউব ‘যুবতী রাধে’ গানের ক্রেডিট অংশে কপিরাইট বিষয়ে কিছু না লেখার বিষয় সরলপুর ব্যান্ডের সদস্য মারজিয়া তুরিন দুদিন আগে কানাডা থেকে বলেন, ‘দ্যাট ওয়াজ আওয়ার মিসটেক। আমরা কখনো ভাবিনি যে গানটি আমরা রিলিজ করার আগে, অ্যালবাম আকারে বের করার আগে এভাবে কেউ করে ফেলবে। আমরা তো আসলে খুব ইয়াং একটা ব্যান্ড। অনেক কিছু জানতাম না। এখন সেগুলোর মাশুল দিচ্ছি আরকি। অনেক কিছু শিখেছি।’সরলপুর ব্যান্ড সদস্যের কথা শুনে মেহের আফরোজ শাওনের মনে প্রশ্নও জেগেছে। তাঁর মতে, কোন ৩০ ভাগ বাউল সাধকের অংশ, সেটা তাঁরা আলাদা করে বললেন না কেন? শুধু তাই নয়, ইউটিউবে তাঁরা যখন গানটি আপলোড করেছেন, তখন গানটি কপিরাইট রেসট্রিকটেড লেখেননি কেন? কপিরাইট করা থাকে মানেই ওই গানের রাজা তিনি বা তাঁরা। লিখলেন না কেন? গীতিকার-সুরকারের নামও তাঁরা লেখেননি। যেখানে সরলপুর ব্যান্ডই তা লেখেনি, সেখানে তিনি বা অন্যরা কোথা থেকে জানবেন বলেও মনে করছেন তিনি।

শাওন জানালেন, সরলপুর ব্যান্ড যে বাউল সাধকের কাছ থেকে গানটি সংগ্রহ করেছে, কৃতিত্ব কেন দিলেন না? তাঁরা যদি দিতেন, অন্য অনেকে তা জানতে পারত। কারণ, এ গানের প্রকৃত মালিক তো একজন বাউল সাধক। একজনের গানের ৩০ ভাগ নিয়ে যদি ৭০ ভাগ অন্য কেউ লিখে দাবি করে তাঁর, সেটার কপিরাইট কীভাবে হয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এই অভিনয়শিল্পী ও গায়িকার।
‘যুবতী রাধে’ গানটি নিয়ে সরলপুর ব্যান্ড সদস্যদের ফেসবুকে লাইভে কথা বলা এবং গান চুরির অভিযোগ তোলার বিষয়টিতে মর্মাহত হয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন। তাঁর মতে, সরলপুর ব্যান্ড সদস্যরা ফেসবুকে ওভাবে অভিযোগ না করে ফোন, মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা মেসেঞ্জারে জানাতে পারতেন। কারণ, তাঁদের সবাইকে খুঁজে বের করা তো অসম্ভব কিছু নয়। শাওন বললেন, ‘আমরা একই জগতের মানুষ। এই গানের সংগীতায়োজক পার্থ দা, তাঁকে খুঁজে বের করাটা কি খুবই কষ্টকর? চঞ্চল চৌধুরী আর আমি শাওনকে খুঁজে বের করে তো তারা বলতে পারত—আপনারা যে গানটা গেয়েছেন, তা আমাদের সরলপুর ব্যান্ডের। কোনো কিছু না করে গানটা হঠাৎ করে ইউটিউব থেকে নামিয়ে ফেলা হলো। ফেসবুকে প্রতিবাদ করা হলো! এসব বিষয় একটু খারাপই লেগেছে। দুঃখজনক। আর কিছু না।’

‘যুবতী রাধে’ গানটি নিজেদের দলের সদস্যের লেখা ও সুর করা দাবি করে মারজিয়া তুরিন তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গানটি আমরা লেখা শুরু করি ২০০৬ বা ২০০৭ সাল থেকে। তখন আমরা কয়েকজন এক দিন সারা রাত পালাগান দেখি। যেখানে রাধাকৃষ্ণ-সম্পর্কিত বিভিন্ন পালাগান হয়েছিল, যা আমাদের খুবই ভালো লাগে এবং মন কাড়ে। তারপর থেকে রাধাকৃষ্ণের গল্পের ওপর নির্ভর করে আমরা গানটি লেখা শুরু করি।

রাধাকৃষ্ণের গল্প থেকে আমরা বিভিন্ন তথ্য-ভাবধারা, শব্দচয়ন সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু কোনো হুবহু কথা আমরা সংগ্রহ করিনি। আমাদের এ গানের সঙ্গে কোথাও কোনো গানের হুবহু মিল নেই। গানটি আমরা সম্পূর্ণরূপে কীর্তন ও লীলাকীর্তনের ওপর নির্ভর করে সুর করেছি এবং সেই ভাবধারা গানটিতে আনার চেষ্টা করেছি।’

এর আগে মারজিয়া তুরিন জানান, ‘যুবতী রাধে’ গানটি তাঁরা ২০১০ সালে ময়মনসিংহ ও শেরপুরে কনসার্টে পরিবেশন করেন। ২০১২ সালে চ্যানেল নাইনে এ গানসহ সাতটি গান আনরিলিজড ট্র্যাক হিসেবে প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন চ্যানেলে একইভাবে আনরিলিজড ট্র্যাকগুলো তাঁরা গেয়েছেন। ২০১০ সালে সরলপুর প্রতিষ্ঠা পায়। এ পর্যন্ত ব্যান্ডটি কোনো অ্যালবাম প্রকাশ করেনি।

প্রথম আলোকে কপিরাইট নিবন্ধন কর্মকর্তা জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘সরলপুর ব্যান্ড “যুবতী রাধে” গানটি নিজেদের লেখা, সুর করা ও তৈরি হিসেবে ২০১৮ সালের ৪ জুন কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নেয়। কয়েক মাস পর ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল সুমি মির্জা নামের একজন শিল্পী আপত্তি তুলে বলেন, গানটি “মৈমনসিংহ গীতিকা”র “যুবতী রাধে” গানের নকল। এরপর কয়েকটি শুনানি হয়। তখন সরলপুর ব্যান্ড ২০১২ সালের একটি রেফারেন্স দেয়, যেখানে দেখা যায়, চ্যানেল নাইনের একটি অনুষ্ঠানে তারা গানটি গাওয়ার সময় বলেছে, এই গানের ৩০ পারসেন্ট তাদের সংগ্রহ আর ৭০ পারসেন্ট তাদের রিমেক করা।’
জাফর রাজা এ-ও বললেন, ‘যেহেতু গানটির কপিরাইট ইস্যুতে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, তাই আমরা তথ্য-উপাত্ত আবার নতুন করে যাচাই-বাছাই করব। এরপর যদি এটি লোকগান হিসেবেই প্রমাণিত হয়, তাহলে যে কেউ তা গাওয়ার অধিকার রাখবে। আর যদি সরলপুর ব্যান্ডের হয়, অধিকার তাদেরই থাকবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here