নিউজবাংলা ডেস্ক: সতীদাহ বা সহমরণ হিন্দু সমাজের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অমানবিক একটি প্রথা। মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীর চিতায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার এই কুপ্রথা হিন্দু সমাজে কীভাবে এসেছে তা নিয়ে নানা মত আছে, নেই সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ। একটি প্রচলিত লোকশ্রুতি আছে যে, ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্যের সূচনাকারী মুহম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের পর রাজা দাহির নিহত হলে তার স্ত্রী লাডি সম্ভ্রম রক্ষার্থে আত্মহত্যা করেন। স্বামীর সাথে একই চিতায় দাহ করা হয় তাকে। সেই ঘটনার সূত্র ধরে হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথার প্রচলন হয়।

সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় সতীদাহ প্রথা নিয়ে পোস্ট চোখে পড়েছে। কেউ কেউ এই প্রথার জন্যে শুধু মুসলমানদের দায়ী করার সাথে সাথে মুসলিম বিদ্বেষও উগড়ে দিয়েছেন। এমন কথা বলা হয়েছে যে, বিজয়ী মুসলমানরা রাজা দাহিরের স্ত্রীর মৃতদেহকে ধর্ষণ করে। এই লোকশ্রুতির ঐতিহাসিক সত্যতা প্রমাণিত নয়। কেউ বলতে চেয়েছেন যে, মুসলিম শাসনাধীনে স্বামীর অবর্তমানে হিন্দু নারীরা নিজেদের সতীত্ব রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকার কারণে স্বামীর সাথে সহ মরণে যেতেন। এ সবের পেছনে যদি ঐতিহাসিক সত্যতা থাকেও তবু এ ধরনের বিষয় সোশাল মিডিয়ায় উপস্থাপন সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয় বলে আমি মনে করি।

রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলন ও লবিংয়ের ফলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা লোপ ঘোষণা করেন। একটি বিলুপ্ত প্রথাকে সামনে আনা এবং এর সাথে জড়িত লোকশ্রুতিকে ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা আমার কাছে উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়েছে। আমাদের সম্প্রদায়গত প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ানোর লক্ষ্যে এসব কাহিনির বয়ান হচ্ছে বলেই আমার বিশ্বাস।

আমি মনে করি, ইতিহাস চর্চা হওয়া উচিত নির্মোহ দৃষ্টিতে। সত্যের খাতিরে ইতিহাস পুনর্লিখন কিংবা পুনর্নির্মাণও হতে পারে। কিন্তু অশুভ উদ্দেশ্যে ইতিহাসের নামে লোকশ্রুতির পরিবেশনা গর্হিত অপরাধ। আমরা বিদ্বেষপ্রবণ সমাজে ফিরে যেতে চাই না। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।

মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেন অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দশকে। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ বলে, ভারতীয় সমাজে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল সেই পৌরাণিক যুগেও। সতীদাহ প্রথা প্রচলনের পেছনে সক্রিয় কারণটি বর্ণিত আছে মহাভারতের কাহিনিতে। হস্তিনাপুরের রাজা ছিলেন পাণ্ডু (জন্মের সময় তার চেহারা পাণ্ডুর ছিল বলে এমন নাম হয়েছে)। তিনি শিকারে গিয়ে যৌনমিলনরত দুটি হরিণকে হত্যা করেন। সেই হরিণ দুটি ছিল আসলে এক ঋষি দম্পতি। শরবিদ্ধ ঋষি পাণ্ডুকে এই বলে অভিশাপ দেন যে, তার মৃত্যু হবে যৌনক্রিয়ার সময়। বসন্তের এক দিনে পাণ্ডু স্ত্রী মাদ্রীর (আরেক স্ত্রীর নাম কুন্তী) সাথে মিলিত হন এবং মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী ভেবে শোকস্তব্ধ মাদ্রী স্বামীর সাথে চিতায় আরোহণ করে সহগামী ন। এমন কাহিনিও প্রচলিত আছে যে, মাদ্রী সহমরণে যাননি, তিনি আসলে স্বামীর শোকে মারা যান। স্বামীর সাথে একই চিতায় তাকে দাহ করা হয়। সেই কাহিনির সূত্র ধরে পৌরাণিককালেই সতীদাহ প্রথার সূচনা হয়েছিল।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৪০০ খ্রিষ্টাব্দ) পূর্ব হতেই এ প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিস্টোবুলুস। এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীর স্বেচ্ছায় সহমরণে যাওয়ার ঘটনা তাঁর লেখা বিবরণ হতে জানা যায়। সতীদাহ প্রথার প্রচলনে রাজপুত নারীদের ‘জহরব্রত’ প্রথার প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন। শত্রু কর্তৃক শহর দখল হবার আশংকা দেখা দিলে রাজপুত নারীরা বিষ খেয়ে আত্মত্যা করত। একেই বলা হয় ‘জহরব্রত’।

সতীদাহ প্রথা প্রচলনের পেছনে সক্রিয় আর্থসামাজিক দুটি কারণ বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, সমাজের লোভী মানুষের চক্রান্ত। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার সম্পদের ওপর নজর পড়ত লোভী স্বজনদের। কিন্তু মৃতব্যক্তির স্ত্রী হয়ে দাঁড়াত পথের কাঁটা। স্বার্থান্ধ মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে ধর্ম ও শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা দিয়ে এই নিষ্ঠুর প্রথা চালু করে। তারা সহমরণকে নারীর স্বর্গপ্রাপ্তির শর্ত হিসেবেই কেবল প্রমাণ করতে চায়নি, এটাকে সতীত্বের প্রমাণ রূপেও চিন্হিত করত। ফলে মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়ে অসহায় নারী সহমরণকে মেনে নিত। আর যারা স্বেচ্ছায় মরতে চাইত না তাদের চিতায় চড়ানো হত জোর করে কিংবা মানসিক বিভ্রমে ফেলে।

দ্বিতীয়ত, সমাজে প্রচলিত বিধবা বিবাহ নিরোধ প্রথা সতীদাহ প্রথার প্রচলনে ইন্ধন যোগাতে পারে। তখনকার দিনে বালবিধবারা ছিল পরিবার ও সমাজের বোঝা। যুবতী নারীদের জন্যে না দেওয়া যেত পুনরায় বিয়ে না রাখা যেত ঘরে। এই বোঝা নামানোর জন্যে সমাজের লোকেরা সতীদাহ প্রথাকে লালন করতে পারে। বিধবা বিবাহ প্রচলিত থাকলে নারীদের নিজেদের জীবনের প্রতি মমতা থাকত অন্যরকম। স্বর্গের চেয়ে তাদের কাছে সংসার হত মূল্যবান, সতীত্ব প্রমাণের মনস্তাত্বিক চাপও থাকত না। আজীবন বৈধব্য বরণের চেয়ে চিতায় যাওয়া নারীদের কাছে শ্রেয়তর মনে হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়।

যে বিন কাসিমকে সতীদাহ প্রথার জন্যে দায়ী করা হয় সেই বিন কাসিমের মৃত্যুর জন্যে রাজা দাহিরের কন্যাদের দায় আছে–এমন কাহিনি বহুল প্রচলিত। জানা যায়, রাজা দাহিরের দুই যুবতী কন্যা উমাইয়া খলিফার দরবারে নীত হন। তাঁরা অভিযোগ করেন, মুহম্মদ বিন কাসিম তাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছেন। খলিফা সঙ্গে সঙ্গে মুহম্মদ বিন কাসিমকে কাঁচা চামড়ার থলেতে ভরে তাঁর নিকট নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। খলিফার নির্দেশকে শিরোধার্য করেন বিন কাসিম। পথের মধ্যে শ্বাসরোধ হয়ে প্রাণ হারান বিন কাসিম। মৃত বিন কাসিম খলিফার দরবারে নীত হলে রাজকুমারীরা অনুতপ্ত হয়ে স্বীকার করেন যে, তারা বিন কাসিমের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। ক্ষুব্ধ খলিফা দাহিরতনয়াদের আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যার নির্দেশ দেন।

যদি মুসলমানদের কারণে এ প্রথার প্রচলন হয়ে থাকে তাহলে মুসলিম শাসনের অবসানেও এর অবসান হলো না কেন? উপরন্তু সতীদাহ প্রথা বিলোপের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল তখনকার হিন্দু সমাজ। রক্ষণশীল হিন্দুরা অভিযোগ তুলেন, বিধর্মী ইংরেজরা দেশের মানুষের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। ১৮৩০ সালে সমাজপতিরা বড় লাটের সাথে দেখা করে আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি প্রতিবাদলিপি হস্তান্তর করেন। একটিতে স্বাক্ষর করেন কলকাতার প্রভাবশালী ৬২৫ জন ব্যক্তি ও ১৩০ জন ব্রাক্ষণ পণ্ডিত, আর দ্বিতীয়টিতে স্বাক্ষর করেন পল্লির ৩৪৬ জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং ২৮জন ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিত। তাঁরা সতীদাহ প্রথা পুনঃপ্রচলনের দাবি করেন। ১৯৩০ সালে ১৭ই জানুয়ারি ধর্মসভা নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার লক্ষ্য নিয়ে। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে একটি মামলা করা হয়। প্রিভি কাউন্সিল এই মামলা খারিজ করে দিলে সতীদাহ নিরোধ আইন টিকে যায়।

সত্য সবসময় কল্যাণকর। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা সফল হয় না বটে, কিন্তু তা মানুষের সাময়িক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আসুন সবাই মিলে একটি প্রীতিময় সমাজসংসার রচনা করি।

লেখক: ফাতিহুল কাদির সম্রাট

সহযোগী অধ্যাপক

বাংলা

লক্ষীপুর সরকারি কলেজ

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here