পীর হাবীবুর রহমান:
গুলতেকিনকে আমি শ্রদ্ধা ও সম্মান করি যে কারনে তা হলো তিনি আপাদমস্তক একজন মর্যাদাশীল রুচিশীল ব্যক্তিত্ববান কমিটেড দৃঢ়চেতা সৎ নারী। প্রতারণা তার চরিত্রকে স্পর্শ করতে পারেনি। সততা ও কমিটমেন্ট তার ব্যক্তিত্ব উজ্জল করেছে। তিনি অভিজাত উচ্চ শিক্ষিতই নন, একজন আদর্শ সৎ প্রেমিকা ও মমতাময়ী মা। তিনি জীবনে দুইবার প্রেমে পড়েছেন সহজ সরল হৃদয়ে বিয়ে করেছেন। প্রথম বিয়ে তিনি যেমন ভাঙ্গেননি তেমনি তিনি কারো জীবন নিয়ে খেলেননি। কারো জীবনকে অভিশপ্ত নয় আলোকিত করেছেন। আফতাব আহমেদও আলোকিত হবেন বলে আমার পর্যবেক্ষনে আশাবাদী। হাতিরপুলের বাসা থেকে ধানমন্ডির বাড়ি পর্যন্ত গুলতেকিন পরিবারের অনেক আড্ডায় বন্ধু সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগ দিয়েছি। এমনকি তিনি সুনামগঞ্জেও গিয়েছেন।
বালিকাবেলায় প্রেমে পড়েছেন ঢাবির তরুন শিক্ষক ও নন্দিত নরক উপন্যাসের লেখক হুমায়ুন আহমেদের। তখন গুলতেকিন বিত্তশালী পরিবারের ইব্রাহিম খাঁ’র আদরের নাতিন। অন্যদিকে হুমায়ুনের নামডাক হয়নি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বাবাহারা টানাপোড়েনের পরিবারের নাবিক। গুলতেকিন তাকে বিয়ে করেছেন। যুদ্ধ করেছেন। পাশে থেকেছেন। সংসার সামলে লেখক স্বামীর পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে ইংরেজী সাহিত্যে ঢাবি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। কবিতায় ডুবেছেন।
উপন্যাস, নাটক সিনেমায় গানে হুমায়ুন নন্দিত নরক থেকে পাঠক ও দর্শক মনই জয় করেননি, বইয়ের নতুন পাঠক সৃষ্টি করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে জায়গা করেছেন। তার মতোন ভক্ত এদেশে কোন লেখকের নেই। হুমায়ুনের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে তার স্ত্রী হিসেবে গুলতেকিনও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। সম্মান অর্জন করেছেন। ‘৭৩ সালে বিয়ে করার পর ২০০৩ সালে বিচ্ছেদ পর্যন্ত তারা সংসার করেছেন। চার সন্তানের জনক জননী হয়েছেন। তাদের বিচ্ছেদ ঘিরে দু’জনই পরিমিতিবোধ রেখেছেন। গণমাধ্যমও তাদের সংবাদ জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের জীবন ঘিরে যতটুকু তুলে আনার ততকুটুই তুলে এনেছে।
হুমায়ুন আহমেদ বালিকা শাওনের প্রেমে পড়ে তাকে জয় করে গুলতেকিনের সাথে বিচ্ছেদের পর বিয়ে করে নতুন জীবন কাটিয়েছেন। আমৃত্যু তার সাথেই ছিলেন। সেলিব্রেটিদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকেনা। পাঠকের কৌতুহল থাকে বলেই সংবাদের বাইরে মৃত্যুও তাদের নিতে পারে না। মানবতাবাদী শ্রেষ্ঠ লেখক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তি জীবন যেখানে এখনো উঠে আসে, সেখানে হুমায়ুন আহমেদ না আসার মতো এমন কি!
অনেকে শাওনের সমালোচনা করলেও আমি তার প্রতি সহানুভূতিশীল কেনো এটা দুই-একদিনের মধ্যে আমার পর্যবেক্ষন ও ব্যাখা বিশ্লেষনসহ একটি স্ট্যাটাস দেবো।
একদল মূর্খ বলছেন হুমায়ুনের জন্মদিন ১৩নভেম্বর গুলতেকিন বিয়ে করেছেন!আসলে গেলো ২৫ অক্টোবর দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে আড়ালে থাকা গুলতেকিন খান ছেলেমেয়েদের সম্মতিতে বিয়ে করেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আফতাব আহমেদকে।
আফতাব আহমেদ একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে পরিচিত। ২০১৩ সাল থেকে গুলতেকিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব। একসময় দেশে সচিবদের নাম মানুষের মুখে মুখে থাকত। এখন গণমাধ্যম কর্মীদেরও থাকে না। সেখানে সচিবালয়ে বিট করা অনেক রিপোর্টারও অতিরিক্ত সচিব আফতাব আহমেদকে চিনেন না। তার কবিতার সঙ্গেও পাঠক কেনো গণমাধ্যমের অনেক সাহিত্য সম্পাদকেরও সম্পর্ক নেই। হয়ত তিনি একজন নিভৃতচারি। প্রচারবিমুখ।
সেটা বড় কথা নয়। গুলতেকিনকে এখন গোটাদেশ চিনেন। তার প্রতি মানুষের সম্মান ও সহানুভূতি আছে। দীর্ঘদিন সন্তানদের লালন পালন করতে গিয়ে তিনি নিঃসঙ্গ বেদনার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। একাকীত্বের দহন একাই বহন করেছেন। তিনি বিয়ে করে সুখী হবার অধিকার রাখেন। সেই অধিকার থেকে তিনি তার পছন্দের মানুষ আফতাব আহমেদকে ভালবেসে বিয়ে করেছেন। দেশের মানুষও তাদের অভিনন্দিত করেছে। এমনকি তার পুত্র নূহাশও গর্বের সঙ্গে বলেছে ‘আমি আমার মায়ের বিয়ে দিয়েছি, এই বিয়েতে আমরা সুখী। বিয়ের সংবর্ধনাও হবে।’ আফতাব আহমেদেরও তার স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে অনেক আগে। প্রায় ১০ বছর। একমাত্র সন্তান লন্ডনে থাকে।
বিয়ের পর গুলতেকিন আমেরিকা গেছেন। শিগগিরই ফিরে আসবেন। গণমাধ্যম আফতাব আহমেদকে খুঁজে বের করেছে। তিনি বলেছেন, তাদের কষ্ট অভিন্ন। এ নিয়ে তিনি না লিখলেও গুলতেকিন লিখবেন। চলচিত্র অভিনেত্রী আয়েশা আক্তারের পুত্র আফতাব আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তিনি বের হওয়ার পর গুলতেকিন এ বিভাগে পড়াশুনা করে উচ্চ শিক্ষা নেন। তিনিও কবিতা লিখেন। তার কাব্যগ্রন্থ চৌকাঠ প্রকাশ হয়েছে।
গুলতেকিনকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর স্যোশাল মিডিয়ায়ও তোলপাড় হয়েছে। ফেসবুকে মানুষের সঙ্গে আইডিয়া বা চিন্তার আদান-প্রদান হয়। হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয় হওয়ার কারণে গুলতেকিন যেমন সারাদেশে যেমন পরিচিত হয়েছিলেন,তেমনি মিডিয়ার সুবাদে গুলতেকিন বিয়ে করার কারণে আফতাব আহমেদও রাতারাতি মিডিয়ার সুবাদে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশিরভাগ মানুষ তাদের অভিনন্দিত করেছেন। অনেকে বলেছেন, এই সাহস দেখিয়ে তিনি প্রেরণা যুগিয়েছেন। এমনকি গুলতেকিন পুত্র নূহাশও বলেছেন, তার মায়ের বিয়ের মধ্যদিয়ে নিঃসঙ্গ নারীদের সাহসের দ্বার উন্মোচন হলো।
ফেসবুকে অনেক জ্ঞানীগুনি মানুষের অস্তিত্ব যেমন দেখা যায় তেমনি মানসিক দৈন্যতার পরিচয়ও অনেকে দেন। মানসিক বিকৃতির প্রকাশও ঘটে অনেকের লেখায়। এমনকি কোনো কোনো গন্ড মূর্খের স্ট্যাটাস পড়ে অবাক হই না। ভাবী চিন্তার ক্ষুদ্রতা যেখানে হাটুর নীচে সেখানে এরচেয়ে আর কি লিখবেন। দেশের রাজনীতিতে যেমন এখন সবাই নেতা, কর্মী খুজে পাওয়া যায় না তেমনি ফেসবুকে সবাই লেখক! ভালো পাঠক খুঁজে পাওয়া যায় না।
গুলতেকিনের বিয়ে নিয়ে কেনো এতো লেখালেখি বা সংবাদ এমন প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন। অনেকে তাদের মানসিক বিকৃতি ও যন্ত্রণা থেকে শাওনকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে এনে গালমন্দ করছেন। এটা তাদের মূর্খতা অজ্ঞতা ও ছোট মনের পরিচয় ছাড়া কিছু নয়।
মানৃষের জীবনেই নয়, জগৎ বিখ্যাত মানুষের জীবনেও অনেক কিছু ঘটে যায়। নিয়তিতে বাধা মানব জীবন রহস্যময়। মানুষের দাম্পত্য জীবন শীতল হতে হতে অমর্যাদাকর পরিস্থিতির শেষ তলানীতে গেলেও অনেকে বাইরে অহংকারের মুখোশ পড়েন। হাসিমুখে ফটোসেশন করেন। যাদের আত্মমর্যাদা নেই তারা সমাজের সাথে নয়, নিজের সাথেই এই প্রতারনাটুকু করেন।
দাম্পত্য জীবনের নামে দোযখে বাস করার চেয়ে বিচ্ছেদ যে মর্যাদার এটা সমাজ অগ্রসর হওয়ার কারণে, নারী পুরুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণে আজকাল বেশি ঘটছে। প্রতিদিন ঢাকায়ই ৬০টির বেশি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। নারী যত সাবলম্বি হচ্ছে তার আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের উজ্বলতা তত বাড়ছে। তবু অনেক নারী সন্তান,পরিবার , সমাজ বা আর্থিক কারনে অমর্যাদার করুনাশ্রিত জীবন কাটান।
একসময় বাল্যবিবাহ সকল ধর্মেই চালু ছিল। অকাল বৈধব্য নিয়ে সারাজীবন সাদা কাপড় পরে সাজসজ্জাহীন জেতা লাশের মতো মুসলমান নারীদের জীবন কাটাতে হয়েছে।
হিন্দুধর্মে আরো ভয়ংঙ্কর মর্মান্তিক ঘটনা ছিল সতীদাহ প্রথা। তারমানে স্বামীর মৃত্যু হলে জীবন্ত স্ত্রীকেও একই চিতায় পুড়ে মরতে হতো। নৃসংস হত্যাকান্ডের এই সতীদাহ প্রথা রাজা রাম মোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে বৃটিশ গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক বাতিল করেন।
ইসলাম নিষিদ্ধ না করলেও মুসলিম পরিবারেও অকাল বৈধব্য পাওয়া দুর্ভাগা নারীদের সামাজিক প্রথায় একসময় বিয়ে না করেই একা সারাজীবন কাটাতে হতো। পরবর্তীতে সেটি চালু হতে থাকে। হিন্দু বিধবাদের বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি মাছ মাংস ও ছুঁতে পারবেনা!ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনে ভারতবর্ষে ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই তাদের বিয়ের অধিকার দেন বড় লাট লর্ড ডালহৌসি আইন করার মধ্যদিয়ে। বিদ্যা সাগর তার পুত্রকেও হিন্দু বিধবা বিয়ে করিয়েছিলেন।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন গুলতেকিনের বিয়ের খবর দিতে গিয়ে তার সাবেক স্বামী হুমায়ুন আহমেদের নাম কেনো আসছে? জীবনের দীর্ঘ সময় যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা মানুষের সঙ্গে সংসার করে গুলতেকিন দেশজুড়ে সম্মান ও পরিচিতি লাভ করেছেন সেখানে তার নতুন জীবন শুরু হলেও ব্যাকগ্রাউন্ড বাদ দিয়ে খবর লেখা যায় না। এটা কে বুঝাবে নিউজপেপার বা গনমাধ্যম থেকে দূরে থাকা পুথিগত শিক্ষিত মূর্খদের!
পৃথিবীর কোথাও সাধারণ মানুষের বিয়ে ও বিচ্ছেদের এমনকি বহুবিবাহের খবরে যেমন মানুষের আগ্রহ নেই তেমনি গণমাধ্যমেও তার সংবাদ মূল্য নেই। এসব প্রশ্ন যারা তুলেন এটা তাদের অজ্ঞতা। বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশই নয় পৃথিবী জুড়ে সেলিব্রেটিদের বিয়ে বিচ্ছেদ প্রণয় পুনঃবিবাহ খবর হয়। সাধারণের হয় না।
গুলতেকিন তার প্রথম স্বামী হুমাযুন আহমেদের কারণে দেশজুড়ে পরিচিত। তার বিয়ের খবরে তাই পাঠকদের তুমুল আগ্রহ ও কৌতুহলের বিষয়। তাই এর সংবাদ মূল্য অনেক। আফতাব আহমেদ যদি অন্য সাধারণ কাউকে বিয়ে করতেন এ নিয়ে খবরও হতো না আলোচনাও হতো না। গুলতেকিনকে বিয়ে করার কারণেই খবরে উঠে এসেছেন।
গুলতেকিন আগে বিচ্ছেদ হলেও জননন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদের প্রথম স্ত্রী হিসেবেই ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার যোগ্যতা মেধা শিক্ষা ও কবি পরিচয় আছে এটা সত্য । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য শিক্ষক রয়েছেন। সবাই হুমায়ুন আহমেদ হতে পারেননি। সাধারণ কোনো শিক্ষক বিয়ে করলেন, নাকি বিচ্ছেদ ঘটালেন এ নিয়ে মানুষের যেমন আগ্রহ নেই গণমাধ্যমেও তেমনি সংবাদ মূল্য নেই।
এখানে গুলতেকিন ও আফতাব আহমেদ আমৃত্যূ যুগলবন্দি থাকুন আনন্দময় দাম্পত্য জীবন কাটান এটাই আমাদের প্রত্যাশা। গুলতেকিনকে এই সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য আগেও অভিনন্দন জানিয়েছি। এখনও জানাচ্ছি।
নিঃসঙ্গ প্রতিটি মানুষ সুখী হওয়ার অধিকার রাখেন। বিয়ে করার অধিকার রাখেন। যেসকল নারী একা থাকার পরও সামাজিকতার কারণে নতুন করে জীবন গড়তে পারছেন না গুলতেকিন নতুন করে তাদের প্রেরণার উৎস। নূহাশ ও তার বোনেরা যেভাবে মায়ের নতুন জীবনকে আনন্দিত করেছে এটাও অভিনন্দন যোগ্য।
একালের সন্তানরা অনেক অগ্রসর। কদিন আগে কলকাতার এক তরুনী যেমন তার নিঃসঙ্গ মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তেমনি আত্মীয় স্বজনদের সমালোচনা উপেক্ষা করে আরেক তরুণ তার মায়ের জন্য পাত্র খুজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সমাজ এভাবে ভাঙ্গে এভাবেই অগ্রসর হয়। পরশ্রীকাতরতা মনের দারিদ্রতা সমাজের অন্ধকার দিক। উদারতা ও শুভ চিন্তাই আলোর দিক। এটাই প্রগতি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনীতি ও সমাজবিশ্লেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here