মোঃ মোশারফ হোসাইন: Soil Science এর ছাত্র সয়েল নিয়ে তেমন কিছু লিখে না, সব সময় আউ ফাউ বিষয় নিয়ে পড়ে থাকে এ নিয়ে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কাছের একজন মেসেজ করে জানিয়েছে, মৃত্তিকা নিয়ে একটা কিছু লিখতে। আজ তাই Soil Related একটা লেখা, একটু প্যাঁচানো। তবে পুরোটা পড়লে আশাকরি ভালো লাগবে। আমরা সকলেই চোরাবালির নাম শুনেছি এবং চোরাবালির ফাঁদে পড়লে কী হয় সেই বিপদের কথা জানা আছে। চোরাবালির ঘটনা সাধারণত ঘটে থাকে সমুদ্রের তীরে কিংবা কোনো জলমগ্ন এলাকায়। কিন্তু কোনো সমতলে যদি এমন হয়? ধরুন আপনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন হঠাৎ করে দেখলেন পায়ের নীচের যে শক্ত মাটি আছে তার প্রকৃতি বদলে এটি তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করলো। যে শক্ত মাটির ওপর আপনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে ঢেউ খেলতে শুরু করলো। মাটির ওপরের সব বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল, সেতু ভেসে যেতে শুরু করলো। তারপর ধসে গিয়ে ডুবে গেল জল-কাদা-বালির এক সমুদ্রে। বিজ্ঞানীরা এ ধরণের ঘটনাকে বলেন Liquefacation (লিকুইফেকশন)। সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে ‘মাটির তরলীকরণ অর্থাৎ মাটি যখন তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করে। সাধারণত ভূমিকম্পের পর লিকুইফেকশন বা মাটির তরলীকরণের ঘটনা ঘটে। এর ধ্বংসক্ষমতা সবচেয়ে ব্যাপক। এর একটা কেতাবি সংজ্ঞা আছে, সেটা হলো-

Soil liquefaction occurs when a saturated or partially saturated soil substantially loses strength and stiffness in response to an applied stress such as shaking during an earthquake or other sudden change in stress condition, in which material that is ordinarily a solid behaves like a liquid.

এখন কথা হলো লিকুইফ্যাকশন কখন ঘটে? যখন কোনো পলিমাটি বা বালু মাটির নীচে কম গভীরতায় থাকে একুইফার বা পানির স্তর। যখন ভুপৃষ্ঠের কাছাকাছি জায়গায় কোন ফল্ট লাইন বা ফাটল বা চ্যূতি পরস্পরের সাপেক্ষে নড়াচড়া করে তখন সেটাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘ফল্ট রাপচার’ বল হয়। এই ফল্ট রাপচার নতুন করে হতে পারে, বা আগের রাপচার নতুন করে সক্রিয় হতে পারে। তবে রাপচার যে কারণেই হোক, ফাটল দুটিকে পরস্পরের সাপেক্ষে নড়তে হবে, নইলে লিকুইফেকশন হবে না। যখন ফল্ট লাইন বা ফাটল রেখাটি নড়াচড়া করে, তখন যে সিসমিক ওয়েভ বা ভূকম্পন তরঙ্গ তৈরি হয়, এবং এই তরঙ্গ যখন লিকুইফেকশন জোনে এসে পৌঁছায়, তখন সেখানকার মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করে। ভূ কম্পন তরঙ্গ যখন ভূপৃষ্ঠের দুশ মিটারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সেখানে যেসব একুইফার বা পানির স্তর থাকে, সেগুলি যদি পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, তখন উপরের মাটি ধসে যাবে, এবং সেই মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করবে, এটিতে ঢেউ খেলতে দেখা যাবে। এবং উপরে যা কিছু আছে, সব ধসে পড়বে বা ভেসে যাবে। বালি এবং পানি মিলে একটি জেলি টাইপের জিনিস তৈরি হয়ে, যেটি উপরে উঠে আসে। আর নীচে একুইফার জোনে একটি ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা তৈরি হয়। তখন সেই শূন্যস্থানে উপরের মাটি ধসে পড়ে। তখন উপরে যত ধরণের স্ট্রাকচার থাকে, সেটা মাটিতে তলিয়ে যায়, মাটিতে ডুবে যায়। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার পালুতে ভূমিকম্পের পর এরকম ঘটনা ঘটেছে। তার আগে নিউজিল্যান্ডে, চিলিতে, জাপান এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশ এই নারকীয় ঘটনার সাক্ষী। ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের কারণে বালারোয়ার পালু এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৭শ বাড়িঘর কার্যত মাটিতে ডেবে গিয়েছিল।

বাংলাদেশে লিকুইফেকশন বা ভূমি তরলীকরণের ঝুঁকি কতটা? বাংলাদেশে যদি বর্ষাকালে বড় ভূমিকম্প হয়, তখন লিকুইফেকশনের ঝুঁকি বেশি। গবেষকদের মতে, ভূমিকম্পে তরল মাটিতে ডুবে যেতে পারে ঢাকার বাড়িঘর। কারণ তখন বৃষ্টির পানিতে ভূগর্ভের পানির স্তর থাকে পরিপূর্ণ। তবে সেই তুলনায় শীতকালের ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের ঝুঁকিটা অনেক কম।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশের যে ভূ-কাঠামো, তাতে Liquefacation এর ঘটনা ঘটার ঝুঁকি অনেক। কারণ বাংলাদেশ খুবই নাজুক অবস্থানে, তবে ভূমিকম্প হলেই যে লিকুইফেকশন হবে, ব্যাপারটা তা নয়। কয়েকটি ব্যাপার একসঙ্গে ঘটতে হবে। এটি নির্ভর করবে ভূমিকম্পটি কতটা শক্তিশালী, মাটির কতটা গভীরে এটি ঘটছে এবং সেখানে যে একুইফার বা পানির স্তর আছে, সেটিতে কতটা পানি আছে তার ওপর। যদি ভূমিকম্প ছয় মাত্রার কাছাকাছি বা তার চেয়ে শক্তিশালী হয় এবং এর উৎপত্তিস্থল যদি দশ হতে পনের কিলোমিটার গভীরতার মধ্যে হয়, তাহলে লিকুইফেকশনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এমনটি ঘটার আশংকা কতটা? ঢাকার অবস্থা খুবই নাজুক। পুরো ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ ভূমির গঠনপ্রকৃতি এমন যে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে এরকম ঘটনা ঢাকাতেও ঘটতে পারে। পুরো বাংলাদেশের বেশিরভাগটাই যেহেতু গড়ে উঠেছে নদী বিধৌত পলিমাটিতে, তাই এরকম লিকুইফেকশনের ঝুঁকি কম বেশি অনেক জায়গাতেই আছে। কেবলমাত্র উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া রাজশাহীর মতো কিছু জেলায় অগভীর মাটিতে শক্ত শিলা বা ‘সলিড ক্রাস্ট’ আছে, যেখানে এর ঝুঁকি নেই। ঢাকা শহরের অন্তত ষাট ভাগ এলাকা এরকম লিকুইফেকশন অঞ্চলে পড়েছে, যেখানে এরকম বিপদ ঘটার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। এই ঝুঁকির ভিত্তিতে ঢাকাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে নারায়নগঞ্জ-ডেমরা-পুরোনো ঢাকা-মতিঝিল থেকে শ্যামলী পর্যন্ত এলাকা।

ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯১৮ এবং ১৯৩০ সালে যেসব বড় ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে যত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়, তার সবই কিন্তু লিকুইফেকশন এর কারণে। ২০০৩ সালে রাঙ্গামাটিতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটার মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ১। কিন্তু সেটির উৎপত্তিস্থল ছিল দশ কিলোমিটার বা এগারো কিলোমিটার গভীরে। সে কারণে প্রচন্ড লিকুইফেকশন হয়েছিল এবং কর্ণফুলী নদীর একটি পাড়ের দীর্ঘ একটি অংশ ধসে পড়েছিল। প্রায় দুই তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদীতীর ধসে পড়েছিল।

এখন এই বিপদ ঠেকাতে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা কতটা কাজ করবে? ঢাকা শহরে এখন যে নতুন বড় বড় ভবন তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোতে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা থাকছে বলে যেকথা বলা হচ্ছে, কিন্তু লিকুইফেকশন হলে সেটি কতটা কাজ করবে? ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাপার ক্ষেত্রে লিকুইফেকশনের ব্যাপারটি দশ বছর আগেও বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে তখন বাংলাদেশের যে সাইসমিক জোনিং করা হয়েছে, সেখানে ঢাকাকে একটা মধ্যম ঝুঁকির সাইসমিক জোনের মধ্যে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পরে যখন মাইক্রোজোনিং করে এই লিকুইফেকশনের ব্যাপারটি বেরিয়ে আসলো, তখন এসব জোনে যেসব দালানকোঠা আগে থেকে গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিটা কতটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই বাংলাদেশের বিল্ডিং কোডে এই লিকুইফেকশনের বিষয়টি কতটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। বাঁচতে হলে এইদিকে মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক: সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জয়পুরহাট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here