ফারুক ওয়াসিফ

আমি কোনো দিন ভোট দিইনি। কাকে ভোট দেব এই বাতিক থেকে ভোটার হইনি অনেককাল। তারপর যে বছর ভোটার হলাম সেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের দিন ঘুরেছি সাভারের গ্রামে। দেখেছি মানুষের সে কী উৎসাহ? দূর-দূরান্তের কর্মস্থল–শিক্ষাস্থল থেকে তরুণেরা বাড়ি এসেছেন: ভোট দিতে হবে। অধিকাংশই শ্রমজীবী আর নতুন ভোটার ছিলেন তাঁরা। এই সব নামহীন–গোত্রহীন মানুষ, যাঁদের অন্য সময় কেউ পোছে না, সেই সব মানুষ আবাবিল পাখির মতো বেশুমার সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে আসেন। চুপচাপ ভোটটা দিয়ে যায়। একেকটি ভোট যেন একেকটি ইট, গণতন্ত্রের ইমারত সেসব ইটে গড়া।

আবাবিল পাখির মতো সংকটের দিনে তারা এসেছে। বাংলার গাঁ-গেরাম-বস্তি-বাকসোবাড়ি থেকে ভাতের গন্ধমাখা গা, সরিষার তেলের গন্ধমাখা চুল আর বাংলার শ্যামল পলির মতো ভেজা চোখের মানুষেরা এসেছে প্রতিটি সন্ধিক্ষণে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসটিতে তাদের কথা আছে, ‘কালো কালো হাজার মাথা এগিয়ে আসছে, স্রোতের মধ্যে ঘাই মারা রুই কাতলার মতো মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে ওঠে আর নামে। উত্তেজিত রুই কাতলার ঝাঁক নিয়ে গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে কোটি ঢেউয়ের দল।’ এভাবে তারা ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় ঢাকায় এসেছে। আর ঢেউয়ের মধ্যে স্রোতের ফেনার মতো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় তরুণেরা-ছাত্রছাত্রীরা। বর্শার লম্বা লাঠির ডগায় ফলার মতো তারা থাকত মিছিলের সামনের ভাগে। সাহস দেখানো, রক্ত ঝরানো, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোয় তাদের কোনো দিন ভয় হয়নি।

ইলিয়াসের উপন্যাসের নায়ক ভাবছে, ‘কিন্তু না, এত মানুষ ঢাকায় সে কোনো দিন দ্যাখেনি। …শায়েস্তা খাঁর টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৪০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই-কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মোগলের হাতে মার খাওয়া, মগের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া-সব মানুষ না এলে এ মিছিল কি এত বড় হয়?…৪ হাজার টাকা দামের জামদানি বানানো তাঁতিদের না খাওয়া হাড্ডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলেছে।…নারিন্দার পুলের তলা থেকে ধোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। …নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠছে আজ, ঢাকা আজ সকাল দুপুর বিকাল রাত্রি বিস্তৃত, আজ তার পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ নাই, সপ্তদশ অষ্টাদশ ঊনবিংশ বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত।…’

এমনিতে যে জনগণ বলে কিছু নেই। সবই চলতি মানুষ, গেরস্ত মানুষ, ব্যক্তি মানুষ, বড়জোর গোষ্ঠী-অ্যাসোসিয়েশন-ক্লাব-দলের মানুষ। কিন্তু গণ-আন্দোলনে যখন লাখো-কোটি মানুষ এক দেহ-মন হয়ে ওঠে কিংবা ভোটের ময়দানে জড়ো হয় হাজারে হাজারে, তখন বুঝতে পারা যায় জনগণ আছে, জনগণ একটা শক্তি। এই শক্তির উদ্বোধন ঘটানোর একটা সুযোগ হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচন ভয়ের পরিবেশে, মানুষকে আটকে রেখে, চুপিচুপি বা কারচুপি দিয়ে করা যায় না।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে অমর গান আছে, ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না, ওরা আসবে চুপিচুপি…’। ছোটবেলা থেকে ভেবে আসছি শহীদেরা কেন চুপি চুপি আসবে? মুক্তির সংগ্রামে যাদের এত বড় অবদান, তারা কেন প্রকাশ্যে কালো চুলের তরঙ্গ দুলিয়ে জলোচ্ছ্বাসের মতো আসবে না? জানালা দিয়ে কেন, কেন আসবে না তারা সদর দরজা-পথ-ময়দান মাড়িয়ে? একই কথা জনগণ নামক আবাবিল পাখির বেলাতেও সত্য। সেমেটিক পুরাণে আছে, ইসলামি লোককাহিনিতে আছে আবরাহা নামের কোনো জুলুমবাজ রাজার হস্তী বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল আবাবিল পাখির ঝাঁক। আবাবিল পাখিকে আমাদের দেশে চাতক বলে। চাতক খুবই ছোট পাখি। একসঙ্গে অনেকে মিলে থাকে, একসঙ্গে ওড়ে। আর একসঙ্গে হলে এরা অসাধ্য সাধন করতে পারে।

মন্দের ভালো খুঁজতে হয়রান আমরা যারা, না–ভোট দিতে উৎসাহী আমরা যারা কিংবা ভোটের বাক্সে লাথি মারতে গিয়ে পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে থাকা আমরা যারা, তাদের কথা এসব মানুষ শোনেনি। তারা উচ্চমহলের একটা কথা বিশ্বাস করেছিল। গণতন্ত্রের আর সব উপকার তারা কম পেলেও তাদের অটুট বিশ্বাস যে ভোট এক পবিত্র আমানত। এর খিয়ানত করা যাবে না, এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। তারা তাদের হাতে রক্ষিত এই সামান্য ক্ষমতাটুকুর ব্যবহার করতে কখনো পিছপা হয়নি। সে জন্যই আমাদের দেশের ভোটদানের হার অনেক পুরোনো ও বনেদি গণতান্ত্রিক দেশের চেয়ে বেশি। এটা যে গর্বের ব্যাপার, সেটাও আমরা ফলাও করে প্রচার করিনি।

কয়েকটি উদাহরণ দিই। ব্রিটিশ আমল। জমিদারি শোষণ আর মহাজনি চোষণে খুব করুণ বাংলার কৃষকের অবস্থা। এদের ঠেকানোর কেউ ছিল না। সে আমলে সবার ভোটাধিকারও ছিল না। অনেক সংগ্রামের পর ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে চার আনা খাজনা দিয়েছে এমন মধ্যকৃষকেরা ভোটাধিকার পেলেন। এর মধ্যে জনগণের ভেতর থেকে উঠে এলেন একজন আইনজীবী এ কে এম ফজলুল হক। তিনি কৃষক প্রজা পার্টি খুললেন। নির্বাচনী ইশতেহারে জমিদারি–মহাজনি ফাঁস আলগা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইতিহাস দেখল আবাবিল পাখিরা জেগে উঠেছে। দলে–দলে ভোটাররা জীবনে প্রথমবার পাওয়া সুযোগে বাংলা থেকে জমিদারি–মহাজনি প্রার্থীদের মোটামুটি উড়িয়ে দিল ভোটের জোয়ারে। আর হক সাহেবের নাম হলো শেরে বাংলা।

জমিদার–মহাজন গেল বটে, কিন্তু চেপে বসল পাঞ্জাবিদের শাসন। বাংলার আবাবিলেরা তাদের জবাব দিয়ে দিল ১৯৭০–এর নির্বাচনে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন যদি সমাজ সংস্কারের শক্তি জোগায়, ’৭০–এর নির্বাচন জোগায় স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের আত্মবিশ্বাস। এই নির্বাচন জাতিকে প্রস্তুত করেছিল একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধু। ১৯৯১–এর নির্বাচনেও আবাবিলদের কারুকাজ দেখা গেল। তাতে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার অধিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশর অর্থনীতির কপাট খোলায় এই ঘটনার প্রভাব বিরাট।

আবাবিলদের উপেক্ষা করা যাবে না। তারাই দেশ–জাতি–রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। ৩০ ডিসেম্বরের দিনে তারা অকাতরে আসুক। তাদের সঙ্গে আমরা যারা এবার প্রথমবারের মতো ভোট দিতে চাই, তাদের দেখা হোক। নাগরিক হিসেবে, ভোটের মালিক হিসেবে, রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে নিজেদের আমরা নবায়িত করে নিতে চাই। চাই সরকারও ভোটের মাধ্যমেই নিজেদের নবায়িত করে নিক। গণতন্ত্রের আবাবিল পাখিরা মুক্ত হোক।

মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে লড়াই করেছিল ৫ লাখ তরুণ। আর আমাদের আছে প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ভোটার! আমাদের আছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি ভোটার। আমাদের আছে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ আর সংগ্রামী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। আমাদের আছে ১৮ কোটি জনগণ। এত বড় আবাবিল বাহিনীর সামনে আবরাহাদের হস্তী বাহিনী কী করতে পারবে?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@protho-alo.info

Sourse : Prothom Alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here