ডা. মোমিনুল ইসলাম বাঁধন :
আমি ছোট বেলা থেকে বরাবরই গনিতে একটু বেশি কাঁচা ছিলাম। ক্যাডেট কলেজ এর ভর্তির জন্য মা কে দেখেছিলাম আমার জন্য অনেক কষ্ট করতে। তার নির্ঘুম চেষ্টার কারণে আর আল্লাহর অশেষ রহমতে ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছিলাম।
কিন্তু কি আর হলো? ক্যাডেট কলেজে তো আর মা কে কাছে পাইনি। তাই যেই লাউ সেই কদু। আবার গনিতে শুধু পাস(৪০-৫০) মার্ক পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ভালোই।
কিন্তু ভালোটা বেশিদিন ছিলো না। অষ্টম শ্রেনী থেকে নবম শ্রেণিতে ওঠার সময় থার্ড টার্ম গনিত পরীক্ষার আগে একটা দুর্ঘটনায় আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো আর তাই আবার গনিত পরীক্ষায় ৪০ পেয়ে পাস করেছিলাম।
যে কারনে ক্যাডেট কলেজ কতৃপক্ষ থেকে বাসায় ফলাফল আসলো আর একটা চিঠি পাঠালো। তখন আমরা বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থাকতাম।চিঠির ভাস্য অনুযায়ী আমাকে নবম শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে ক্লাস করতে বলা হলো।
আমার এখনো মনে আছে, আমার মা এর চোখে পানি চলে আসলো আর বলেছিলো “আমার ছেলে কিভাবে ডাক্তার হবে মানবিক বিভাগে পড়লে”।
আমার মা আমাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, কারণ আমার মা আমাকে ডাক্তার বানাতে চায় যেটা মানবিক বিভাগ থেকে সম্ভব ছিলো না।
তখন শিক্ষাবোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত হইলো আমাদের ব্যাচ(৯৮-২০০০)থেকে নতুন সিলেবাস আর নতুন বই নিয়ে কোর্স শুরু হবে। আর যে কারণে আমরা প্রথম ছয় মাস পুরাতন বই নিয়ে পড়তে থাকি কিন্তু আমাদের কয়েকজনকে কলেজ কতৃপক্ষ কোনভাবেই বিজ্ঞান বিভাগ দিবে না।
ঐ সময়ে কলেজের প্রিন্সিপাল পরিবর্তন হওয়ার সুবাদে আমরা আবার আবেদন করার সুযোগ পেয়েছিলাম মানবিক থেকে বিজ্ঞান শাখায় আসার জন্য।
আর কলেজ কতৃপক্ষ আমাদেরকে আবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিলো। আমরা ছুটিতে গেলাম আর ছুটির পর পরীক্ষা তাই আমার মা এর আবার সেই নির্ঘুম চেষ্টা। যে কারণে ভালো ফলাফল করার সুযোগ পেয়েছিলাম আর সেই সাথে বিজ্ঞান বিভাগে যাত্রা শুরু করার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
সেই সময়ও আবার মা ছিলেন আমার পাশে।
এভাবে এইচএসসি পাস করলাম। এইচএসসি পাস করার পর যখন মেডিকেল এ ভর্তির জন্য যখন আমার মা চেষ্টা চাল্লাচ্ছিলো তখন মাথায় ভূত চাপলো, যেভাবেই হোক সেনাবাহিনীতে যোগাদান করতেই হবে।আমার মা কে সেটা বুজতে দিলাম না।
তাই ডাক্তারী ভর্তি পরীক্ষার পড়ালেখা ছেড়ে সেনাবাহিনীর জন্য চেষ্টা করতে থাকলাম। প্রথমবার মিস করলাম আর সাথে সাথে সরকারি মেডিকেল কলেজের সু্যোগটাও মিস করলাম। আমার মা সেইদিন মন থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছিলো কিন্তু বাবা মা আমাকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে চাইলো কিন্তু আমি সেনাবাহিনীর জন্য ভর্তি হতে চাই নাই। কিন্তু তাদের অনুরোধে মেডিকেলে ভর্তি হলাম।কিন্তু তখনও সেনাবাহিনীর ভূতটা মাথা থেকে যায়নি।
একদিন বাসায় না জানায়ে চলে গেলাম রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ। সেখানে আবার সেনাবাহিনীর জন্য আবার ফর্ম ফিল আপ করে ঐ দিনই ঢাকা ফিরে এলাম। কিন্তু বাবা মা কেউ বুজতে পারে নাই।
বাইরে থেকে একদিন বাসায় এসে আমার মা কাঁদতে কাঁদতে আইএসএসবি এর পরীক্ষার চিঠি দিলো আর কিছু না বলেই রুমে চলে গেলো আর বাবাও আর কথা বললেন না।
যেই দিন পরীক্ষার জন্য ব্যাগ নিয়ে বের হবো সেইদিন আমার মা আমাকে বলেছিলো, “বাঁধন, তোমার বাবা অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে তোমাকে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন, তুমি টাকাটা নষ্ট করো না”
কিন্তু কে শুনে?
আমি গেলাম আর সেইবারো চান্স পেলাম না।
হয়তো বাবা মা এর আশীর্বাদ সাথে ছিলো না।
পরবর্তীতে মনের বিরুদ্ধেই ডাক্তার হলাম।
কনসালটেন্ট ও সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য চোখের হাসপাতালে কাজ করার সুযোগও পাচ্ছি।
আসলে এত কথা বললাম কারণ, একজন বয়স্ক মহিলা যার দুই চোখেই কিছু দেখতো না। কয়েকদিন আগে তার চোখের রেটিনা অপারেশন করার পর আজ এসেছিলো চেক আপ করাতে। আলহামদুলিল্লাহ এক চোখে কিছুটা দেখতে পারছে।
আজকে আমাকে দেখে বার বার আমার মাথায় আদর করতে করতে বললেন, বাবা তোমার জন্য অনেক দোয়া করি, তুমি অনেক বড় হও,
বাবা, তোমাকে যে জন্ম দিয়েছেন তিনি অনেক ভাগ্যবান যে, তোমার মত ছেলে জন্ম দিয়েছে।
আসলে এই ধরনের কথা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
এটা বলার পর, আমি জানি না কেন যেন আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো আর আমি সেই জায়গায় থাকতে না পেরে তাড়াতাড়ি তাকে না বলেই বাথরুমে চলে গেলাম।
আজ আমার সাথে আমার মা নেই আর ঐ মহিলার কথা শোনার পর উপরের সব ঘটনা আমার চোখের সামনে এক মুহুর্তেই চলে আসলো।
আর ভাবতে থাকলাম, যেই ছেলে কখনো ডাক্তার হতে চাইনি যে তার বাবা মা এর ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করা সত্বেও ডাক্তার হলো কিভাবে?আসলেই কিভাবে সম্ভব?
সবই মনে হয়, যে মানুষটি আমাদের ছেড়ে ওপারে চলে গেছেন তার দোয়াতেই সম্ভব হয়েছে তাই না?
আর মনে মনে আল্লাহকে বললাম, আজ যদি সে বেঁচে থাকতো তাহলে কি বা ক্ষতি হতো? হয়তো এই কথাগুলো এখানে শেয়ার না করে আমার মাকেই শেয়ার করতে পারতাম, তাই না।?
জীবনের প্রতিটি বাধাতেই আম্মু আমার পাশে থেকে, কখনো আদর করে, কখনো জোড় করে আমাকে সামনে নিয়ে আসছিল। আসলেই গনিতে অনেক কাঁচা ছিলাম তাই মা এর এত ভালোবাসার অংকটা বুঝতে অনেক দেরী করে ফেলেছি।
এখন বুঝতে পারছি প্রতিদিন যখন এত রোগীর সাথে কথা বলছি,যখন রোগীরা ভালোবেসে দুটো কথা বলে তখন মনে হয় মা এসে আমাকে দোয়া করছে। হয়তো মা এর অবাধ্য হয়ে অন্য প্রফেশনে থাকলে মা হয়তো এভাবে আসতেন না।
কোন সন্দেহ নাই, আজ আমি যতটুকু, তার সম্পুর্নটাই তোমার দোয়া, তোমারই প্রচেষ্টা আর তোমারই অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনেক নির্ঘুম রাতের ফলাফল।
ভালো থেকো আম্মু ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই হাসপাতাল, ঢাকা।
জীবন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নিয়ে স্মৃতিচারণূলক লেখাটা অনেক সুন্দর হয়েছে।
Nice and memorable