ছবি: সংগৃহীত

আবদুর রহমান মল্লিক:
নানা ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে করোনা আতঙ্কের একটি মাস পেরিয়ে গেল। পিলে চমকে যাওয়া ভাইরাস প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়ে এক অকল্পনীয় জীবনাচারের অনুশীলন করতে বাধ্য করছে। যে কাজটি আগে নাগরিকবোধ থেকে আমরা করিনি তা এখন করোনার ভয়ে করছি। করোনা কি শুধুই ভাইরাস নাকি ঈশ্বরের হাত(কল্পিত)। আমাদের দম্ভ অহঙ্কার চূর্ণ করতে আর বেপরোয়া জীবনাচারের লাগাম টেনে ধরতেই করোনার আগমন। যদি সেটাই হয়ে থাকে তবে করোনা তুমি এই নগন্য মানুষের অভিবাদন গ্রহণ করো। প্রকৃতির এতো দান অনুদান যদি আমাদের বিনয়ী না করে। উল্টো যদি দাম্ভিক আর অহঙ্কারী করে তবে এই প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার অধিকার আমার নেই। তাই করোনা তুমি এই অকৃতজ্ঞ আমার ভেতরের ফুসফুসকে অকার্যকর করে দাও। পৃথিবীর নির্মল বাতাস ভেতরে টানবার অধিকার আমার নেই। কারণ দান অনুদান পাবার অধিকারী তো সেই যার পাবার অধিকার আছে।
কদিন আগেও ভাবতাম বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী। কারণ বহু কাজ পড়ে আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে। যদিও সেগুলো শেষ হবার নয়। এখন আর সেসব ভাবতে ইচ্ছে করে না। এখন বলি করোনা তুমি যা খুশি তাই করো। কারণ তোমার ভয়েও আমি নিজেকে সংযত করিনি। আজও আয়নায় চেহারা দেখিনা। নিজেকে না দেখে শুধু অন্যকে দেখি। করোনা তুমিতো এই ভূখন্ডে এসেছো। গত একমাসে আমাদেরকে স্বচক্ষে দেখেছো। তোমার ভয়ে আমারা ভীত নই একটুও। নইলে এই আক্রান্ত জনপদে জনপ্রতিনিধি হয়ে চাল, ডাল তেল চুরি করছি কী করে? ভেজাল মাস্কের ব্যাবসা করার দুঃসাহস কোথায় পাই। নিজের দায়িত্ব ভুলে এখনো অন্যকে দোষারোপ করি। অন্যকে দোষারোপ করে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করি। নিজেকে জাহির করার জন্য কত কি না করছি। সামনে ক্যামেরা না থাকলে দুমুঠো চাল কোনো অসহায় মানুষের হাতে তুলে দিতে পারি না। রাষ্ট্র ও জনগণের চাল জনগণের হাতে তুলে দিতেও চুরির ধান্ধায় মেতেছি। দেশে করোনা কীট তৈরি হলেতো কোনো লাভ নেই। লাভ আছে আমদানীতে। তাই আমার তোড়জোর আমদানীতে।
আমার সব কাজ বৈধ এবং আইনসিদ্ধ কারণ আমার গলায় ঝুলানো আছে দেশপ্রেমিকের আইডি কার্ড। যারা কিট তৈরির কাজ করছে ওরা শুধুই পন্ডশ্রম করছে, ওরা উন্নয়নের ধারণাটাই বোঝে না। সেই কবে বাল্যশিক্ষায় পড়েছি ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’। আমি সেই অশ^ারোহী জোয়ানের কথা মনে করতে পারি।
যে আছাড় খেয়ে খেয়ে ঘোড়ায় চড়া শিখেছিল। কিন্তু আমরা গত পাঁচ দশকেও ঘোড়ায় চড়া শিখলাম না। ঘোড়াটা বড্ড বেয়াড়া। এদেশের জনগণ ওই ঘোড়ার মতো। বারবার আছাড় খেয়েছি কিন্তু জনগণকে আয়ত্ব করা শিখিনি। বেয়াড়া জনগণ যেন কিছুই বোঝে না। গার্মেন্টস খুলে দিলে তারা সামাজিক দূরত্ব মানেনা। তারা গাড়ি না পেলেও শত মাইল পথ হেঁটে পাড়ি দিতে পারে? কেউ কেউ আবার আবার জানাজার নামাজে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামিয়ে দেয়।
দেশ নিয়ে আমার এন্তার ভাবনা। ভাবনার কোনো শেষ নেই। তাই নন্দলালের মতো ভাবি ‘অভাগা দেশের হইবে কি? গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিট তৈরি করে জুতা আবিষ্কারের মতো অস্বাধারণ কাজ করেছে নাকি তামাশা করেছে তা আমার বুদ্ধির অগম্য। কারণ যিনি আমাকে দেশ প্রেমের আইডিটা দিয়েছেন তার অমতে কি করে এটাকে অস্বাধারণ বলি। অনেক ঝানু ঝানু দেশপ্রেমিক চুপ করে করে বসে আছেন। আমার অত বুঝে কাজ নেই। কারণ গুণধর কবি নির্মলেন্দু গুণ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একহাত নিতে গিয়ে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও পত্রিকান্তরে বাচচিত চলছে।
একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেখলাম ভিয়েতনাম নামের দেশটি কীভাবে করোনা মোকাবেলায় সরকার অত্যন্ত স্মার্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। ভাইরাস সনাক্তকরণে সরকার জনগণের মাঝে ব্যাপক পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। সে দেশের জনগণ সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছে। দশকোটি নাগরিকের দেশে সংক্রমণের ঘটনা ঘটলেও কারো মৃত্যুবরণের খবর পাওয়া যায়নি। তিন সাড়ে তিন শত লোক সংক্রমিত হলেও তারা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েই উঠেছে। তারা কোনো কাজেই লেজেগোবরে অবস্থা করেনি।
সকালে কিছু সময়ের জন্য রাস্তায় বাজার বসলেও মুহূর্তের মধ্যে তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেদেশের নাগরিকেরা। কিছু সময় পরে বোঝার উপায় থাকেনা যে সেখানে একটু আগে বাজার বসেছিল। বিভিন্ন দেশের ওপর চোখ রাখা দরকার তারা কীভাবে পারছে। ব্যাপক অব্যাবস্থাপনার মধ্যদিয়ে চলছে করোনা কালের এই বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রের কোনো বিভাগের সাথে কোনো বিভাগের সমন্বয় নেই। বিশেষ করে আমাদের স্বাস্থ্যবিভাগের অব্যাবস্থাপনা সবচেয়ে বিপর্যয়কর। তারা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের প্রতি তাদের নেই সঠিক দিকনির্দেশনা। মানুষ অসুস্থ হলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়। ডাক্তার আশা ভরসার স্থল। সেই ডাক্তারেরই ছিলনা নিজের সুরক্ষা ব্যাবস্থা। ভাইরাসের সাথে যুদ্ধটা তারা করবেন কী করে। যে কারণে ডাক্তার যখন সংক্রমিত হতে থাকল তখন জনমনে সৃষ্টি হলো গভীর আতঙ্ক। ডাক্তার মইনউদ্দিন ৬ এপ্রিল সংক্রমিত হবার পর মারা যান ১৫ এপ্রিল। তার মৃত্যুর ঘটনা আমাদের সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে। বেদনার সাথে আমাদের আতঙ্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
করোনা দুর্যোগের এই সময়ে প্রবাসীদের দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে এটা কে না বোঝে। অথচ ইতালিতে করোনা সংক্রমিত হবার পর যখন ১৪ মার্চ প্রবাসীদের একটি বড় দল দেশে প্রবেশ করে তখনও নূন্যতম কোনো ব্যাবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়। তাদের যদি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হতো তবে সংক্রমণের মাত্রা অনেক কমে যেত। অথচ বিমান বন্দর থেকে তাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে দেওয়া হলো। আইডিসিআরে ফোন করে যখন মানুষ সেবা পাচ্ছিলনা তখন ভুক্তভোগীদের সেই সব মর্মন্তুদ কাহিনি পড়ে মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায়। ক্ষুধা ও ভয় এমন একটি জিনিস যা মানুষ নিজের ভেতর চেপে রাখতে পারে না। কোটি কোটি মানুষ আজ ক্ষুধার্ত, বরাদ্দের সাহায্য সবার কাছে পৌঁছছে না। সরকারি আয়োজনের অবস্থা দেখে মানুষ আরো ভীত হয়ে পড়ছে। তারা কার কাছে সাহায্য চাইবে। রাষ্ট্রতো মানুষকে অভয় দিতে পারছেনা। এ অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা লক্ষীপুরে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হলে তার দায় সরকার এড়াতে পারে না। বেতন দেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা অসহায় শ্রমিকদের শত মাইল হাঁটিয়ে রাজধানীতে এনেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। শ্রমিকদের বিক্ষোভকে শুধু দায়ী করা চলবে না। তাই করোনা শুধু মহামারি কিংবা দুর্যোগ হিসেবেই আসেনি। আমরা আয়নার নিজেদের চেহারা দেখার সুযোগ পেলাম। আমার নিরাপত্তার দায়িত্বশীল পুলিশ একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে। তারা যদি এক সময় ভয়ে আতঙ্কে রাস্তা ছেড়ে দেয় তখন পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যেন করোনার ভয়ে গুটিসুটি মেরে গেছেন। তারা যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অধিনে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিদিন মনিটর করতেন। সেখানে যে সমস্যা আছে তাৎক্ষণিক মনিটর করতেন তাহলে সমস্যা এতো প্রকট হতো না। হতাশা মানুষের মুখে মুখে। গাড়ি ঘোড়া চলতে শুরু করায় করোনা সংক্রমণের ভয় বাড়ছে। আপাতত হতাশার তিমিরেই রয়ে গেলাম আমরা। সবার মনে একই প্রশ্ন কবে ফিরে যাবো স্বাভাবিক জীবনে।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here