জাতীয় নির্বাচনে ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন নতুন খবরে বিস্মিত হচ্ছি! এ বিস্ময়ের কারণ কিছুটা স্বাভাবিক বিনোদন, আর কিছুটা গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক চরিত্রের হাস্যকর আচরণ। বাংলাদেশে নির্বাচন একদিকে যেমন রাজনৈতিক উৎসব, অন্যদিকে এই নির্বাচনী রাজনীতির অস্বাভাবিক গতিবিধি কখনো কখনো আতঙ্কেরও।
একটি ভালো নির্বাচনের যে কয়েকটি সূচক আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় সেগুলো হচ্ছে : একটি পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা। নির্বাচনের দিনে যাতে ভোটাররা নিরাপদে কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করা এবং সবশেষে নির্বাচনের ফলাফল সব পক্ষের মেনে নেওয়া। এ সূচক বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোর সামনে দাঁড় করালে কমবেশি সব নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে। এর মধ্যে এক বিচারপতি কমিশনারের নেতৃত্বে সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করার নজির যেমন আছে, তেমন আছে নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিহিংসায় পূর্ণিমার আর্তনাদ, আছে সাড়ে ছয় শ স্কুল ভস্মীভূত হওয়ার দৃশ্য, আছে দিনাজপুর ও যশোরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘এ দেশে জন্ম নেওয়াই আজন্ম পাপ’ স্বগতোক্তির স্পর্শকাতর উচ্চারণ, আছে সারা দেশে পোড়া গন্ধের মর্মন্তুদ বিষাক্ত প্রবাহ। এ দেশে নির্বাচন কমিশন হচ্ছে একটি হতভাগা প্রতিষ্ঠান; আজ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানটি কখনই সবার সন্তুষ্টিবিধান করতে পারেনি। নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ সব সময়ই দোষারোপ করেছে নির্বাচন কমিশনকে। এজন্য নির্বাচন কমিশন কতটা দায়ী আর রাজনৈতিক দলগুলো কতটা, সে নিয়ে নানা আলোচনা হতেই পারে। তবে নির্বাচন কমিশনকে সেই মনীষীর কথাটি স্মরণ রাখতে বলি : তুমি যদি সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতে চাও তাহলে কোনো দায়িত্ব পালনের দরকার নেই, আইসক্রিম বিক্রি কর গিয়ে। আইসক্রিমের বিরুদ্ধে সম্ভবত কেউ নেই।
নির্বাচন নিয়ে এত গুরুগম্ভীর সূচনার কারণ গুরুগম্ভীর কিছু মানুষের আচরণ ও কথাবার্তা। কয়েক দশকের সাংবাদিকতায় অনেক নির্বাচন ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করার কারণে, কিছু সাধারণ বিনোদন এখন আর মনে তেমন প্রভাব ফেলে না। অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন কৃষক সাদেকের কথা। দেশে যেখানেই নির্বাচন সেখানেই তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। মনোনয়নপত্র কেনার জন্য যাদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকও ছিলেন। তখন শুধু প্রিন্ট মিডিয়ার যুগ, এই কৃষক সাদেককে নিয়ে নির্বাচনী বিনোদনের খবর যে কত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার হিসাব নেই। বাবা ছেলে, শ্বশুর জামাই এমনকি শাশুড়ি জামাই, চাচা ভাতিজার লড়াই তো বরাবরই বিস্তর বিনোদনী খবর। ময়মনসিংহের গৌরীপুর এলাকার জনৈক বোকাইনগরীর নির্বাচনে দাঁড়ানো নিয়ে শোনা গল্প । বোকাইনগরীর নিষ্কলুষ স্বীকারোক্তি ছিল নির্বাচনী বিনোদনের শীর্ষে। সহজ সরল, সাদামাটা প্রায় হতদরিদ্র এই মানুষটিকে যখন এলাকার বিশেষত তরুণরা নিছক মজা করার জন্য নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিল; প্রচারণার শুরুতেই বোকাইনগরী তাঁর চাহিদার কথাটি জানালেন। বললেন, আপনারা যখন সবাই বলছেন, তখন নির্বাচন আমি করব, কিন্তু আপনাদেরও কথা দিতে হবে আমাকে তিন মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করবেন, এ নিশ্চয়তা চাই। সবাই তো হতবাক! কেন, তিন মেয়াদের জন্য কেন? বোকাইনগরীর নিপাট সরল জবাব, আমার তো ঘরবাড়ি, বিত্তবৈভব কিছুই নেই, কাজেই প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে যা কিছু আয় উপার্জন হবে তাই দিয়ে নিজের জন্যকিছু করব, দ্বিতীয় মেয়াদে করব আত্মীয়স্বজনদের জন্য, আর জনগণের জন্য করব তৃতীয় মেয়াদে। রাজি থাকলে বলেন; নির্বাচনে নামি!!!এখন যারা নির্বাচনে নামেন তারা বোকাইনগরীর মতো বলেন না, কিন্তু তলে তলে আসলে সবাই বোকাইনগরী। বোকাইনগরী তো বলেছিলেন শুধু এক মেয়াদে নিজের জন্য কিছু করবেন কিন্তু আজকের বোকাইনগরীরা বলেন জনগণের কথা, বলেন গণতন্ত্র ও দেশোদ্ধারের কথা, চেতনা আর আদর্শের কথা, আসলে বেশির ভাগেরই দর্শন ‘ওলট-পালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই’। এ সরল সিদ্ধান্তে আসার কারণ নির্বাচনী হলফনামা। নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামা দেখছি, আর চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে। এক বিশাল মহারথী, বাংলাদেশের ব্যবসাজগতের কথা উঠলেই যার নাম সমান্তরালে আসে, ঘোষণা দিলেন ‘তিনি সর্বহারা’। দুঃখিত, তিনি সর্বহারা এ কথা বলেননি, বলেছেন তাঁর কোনো সহায়সম্পদ নেই। বাড়ি-গাড়ি তো দূরের কথা, তার নাকি কোনো আসবাবপত্রও নেই। তিনি অবশ্য বোকাইনগরীর মতো কোনো ঘোষণা দেননি। তবে তিনি নির্বাচিত হলে যে কিছু সহায়সম্পদ গড়ার সুযোগ দিতে হবে; সে তো বলাই বাহুল্য! তবে এই ‘কিছু’ যে ‘কত’ তার হিসাব কে রাখবে? এক ‘আদর্শবাদী’ নেতা পাওনাদারদের তাগাদায় হাবুডুবু খাচ্ছেন, কোনো নিয়মিত আয়ও নেই। তিনি নাকি নির্বাচন করবেন শ্যালিকার কাছ থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে। আহারে, এমন শ্যালিকাভাগ্য কয় দুলাভাইয়ের হয়? দুদক কি খোঁজ নেবে, শ্যালিকার অ্যাকাউন্ট কীভাবে এত পূর্ণ। ভাবি, এ নেতা নির্বাচিত হলে তো বিদেশে অবস্থানরত শ্যালিকার পাওনা শোধ করতে হবে কষ্টাার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে, নাকি শ্যালিকার পক্ষ থেকে এ দান হবে দুলাভাইকে দেওয়া ‘অফেরতযোগ্য’ দান। তবে বিরোধী দল সরকারি দলের যত সমালোচনাই করুক, দেশে যে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে প্রবলভাবে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। তবে এটাকে নারীর ক্ষমতায়ন না বলে বরং রাজনীতিকদের স্ত্রীদের ক্ষমতায়ন বলাই বোধ করি ভালো। সম্পদে মালিকানা না থাকলে নাকি প্রকৃত ক্ষমতায়ন হয়েছে বলা যায় না, সেই সূত্র ধরেই বলছি। নির্বাচনে একেক প্রার্থীর স্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ দেখে তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! এক বড় দলের মহাসচিব এতটাই দীন যে, স্ত্রীর দেওয়া গাড়িতে চলতে হয় তাকে। এ গতিতে যদি নারীর সম্পদ বাড়তে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারী উন্নয়নের বা নারীর ক্ষমতায়নের এ উল্লম্ফন নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা করতে হবে।
এতসব নির্বাচনী বিনোদনের ডামাডোলের সময় নাকি স্বর্গে দুই বাঙালি কবির মধ্যে প্রবল আনন্দ ও হাস্যরসের বন্যা বয়ে গেছে। স্বর্গবাসী দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম নাকি জীবদ্দশায় ‘নৌকাডুবি’ বা তরুণ দল নিয়ে সাহিত্য রচনা করে মর্ত্যওে এতটা আনন্দ কখনো পাননি, যা পেয়েছেন মৃত্যুর এত দিন পরে। নয়াপল্টনে দেশের একটি বড় দলের আবাসিক ‘গুহাবাসী’ মাঝারি নেতা, এই দুই কবিকে বিএনপির দলভুক্ত করে বিবৃতি দিয়ে তাদের যে নির্মল বিনোদন দিলেন তা নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। সুযোগ থাকলে ওই দুই কবি নাকি আসন্ন নির্বাচনে ধানের শীষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এই স্বীকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে, মর্ত্যরে বাংলাদেশে আসার জন্য ঈশ্বরের অনুমতি প্রার্থনা করতেন। তবে স্বর্গে যাই হোক, মর্ত্যে ওই নেতার মন্তব্য নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। কেউ কেউ ওই আবাসিক নেতার দলটির দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলে বলছেন, এ দলটিতে যোগ দিলে কি কারও মতিভ্রম হয়, নাকি কারও মতিভ্রম হলে সে এ দলটিতে যোগ দেয়? ওই দলের প্রাণপুরুষ যারা তারাই বিশদ বলতে পারবেন।
তবে মতিভ্রমেরও নানা রূপ দেখছি। এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই, ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার পর তাঁর অসমসাহসী প্রতিরোধযুদ্ধ ইতিহাসেরই অংশ। সেই বীরের মতিভ্রম হলো সর্বশেষ রাজনীতির সমীকরণে। তিনি বলছেন দেশে নাকি জামায়াত নেই। কানের মধ্যে বেঁজে উঠল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলে যার মৃত্যু হয়েছে, সেই আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের কর্কশ কণ্ঠস্বরটি। তিনি তখন বিএনপি-জামায়াত সরকারের মন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদের মন্তব্য : বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। বহুদিন পর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখের প্রায় একই ধরনের মন্তব্য শুনতে হলো। এই একদা বীরের বর্তমান সহযাত্রী একসময় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরবে যিনি সম্মানিত, নৌকা ছেড়ে ধানের শীষ নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। বলছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যই ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর মতিভ্রম হতেই পারে, কিন্তু দেশের সব মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে, এমনটা তিনি ভাবলেন কী করে? এই সাবেক ছাত্রনেতা যে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন, সেই ধানের শীষেই আশ্রয় নিয়েছেন ২৩ জন ভয়ঙ্কর জামায়াত নেতা। এত বিএনপির মধ্যে জামায়াতের প্রকাশ্য ‘আত্মগোপন’। নির্বাচনে যদি তিনি জেতেন আর ওই ভয়ঙ্কর ২৩ও জেতেন তাহলে মহান জাতীয় সংসদে তারা পাশাপাশি বসে যে ‘ভয়ঙ্কর রংধনু’ তৈরি করবেন তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
বিশিষ্টজনদের মতিভ্রমের সবশেষ ঘটনায় বিস্মিত হলো গোটা জাতি জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন করায় শ্রদ্ধেয় নেতা ড. কামাল হোসেনের মারমুখী আচরণ দেখে। তিনি যে ফ্রন্টটির শীর্ষ নেতা তা গঠনের শেষ বৈঠকের পর কথা বলছিলাম। তিনি বার বার দেশে সুস্থধারার রাজনীতির কথা বলছিলেন, গণতন্ত্র নিয়ে বলছিলেন, বলছিলেন দেশ, মানুষ নিয়ে তার অনেক স্বপ্নের কথা, বড় দলগুলোর প্রচলিত ধারার ভোটের রাজনীতিতে তিনি যে হতাশ এ কথাও বলছিলেন এক টেলিভিশন টকশোয় অংশ নেওয়ার আগে। কিন্তু পরে তার মতিভ্রম হলো। তিনি শুধু প্রচলিত ধারার ভোটের রাজনীতিতে আত্মসমর্পণই করলেন না, এমনভাবে বিলীন হলেন যে, তার আচরণ দেখে জাতিরই বিভ্রান্ত হওয়ার পালা। জোটের নেতা হওয়ার আগে ‘জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধার প্রশ্নই আসে না’ বলে তিনি যে হুঙ্কার ছাড়তেন হঠাৎ তা যেন মিউমিউ শব্দে পরিণত হলো। এমনকি জামায়াতকে রক্ষার জন্য বিএনপি যে ইজারাদারি নিয়েছিল তিনি যেন সেই জামায়াতের নতুন জিম্মাদার হলেন। জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি যেভাবে সাংবাদিকের ওপর চড়াও হলেন, এই ড. কামাল হোসেন তো আমাদের পরিচিত ড. কামাল হোসেন নন! সাংবাদিকের প্রশ্ন করার অধিকার যেমন আছে, সে প্রশ্নের জবাব না দেওয়া বা তার মতো করে জবাব দেওয়ার অধিকার তার আছে। কিন্তু সাংবাদিক বা সাংবাদিক যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠানকে চিনে রাখার হুমকি শুধু অশোভনই নয়, রীতিমতো ভীতিকর? সাংবাদিকরা নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকি মোকাবিলা করেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। বলা হয়, একজন সাংবাদিককে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিদিন কুমিরভর্তি পুকুরের মধ্যে সাঁতার কাটতে হয়। এ কুমির কখনো সরকার, প্রশাসন, অদেখা শক্তি, দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিক। অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে খবরটি যায় সে-ই কুমির হিসেবে আবির্ভূত হয়। ড. কামাল হোসেনও শেষ পর্যন্ত এই সাংবাদিকবিরোধী কুমিরের তালিকায় নাম লেখালেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ড. কামাল সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করলেন; জামায়াতসংক্রান্ত প্রশ্ন করার জন্য কত পয়সা নিয়েছ? এত দিন ধরে যে সাংবাদিকরা গণফোরামের খবর সংগ্রহ ও প্রচার করছে, তার নতুন জোটের খবর সংগ্রহের জন্য মধ্যরাত পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের বাসার সামনে অবস্থান করছেন অথবা কাক-ভোরে তাদের ডেকে নেওয়া হয়েছে ব্রিফিংয়ের জন্য, বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করি, কোন দিন কোন সাংবাদিককে ড. কামাল হোসেন বা তার দল কত টাকা দিয়েছেন? সেই হিসাবটি প্রকাশের জন্য চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি। এই ড. কামাল হোসেন যখন তার জোটের ইশতেহারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলেন, আচরণ ও বক্তব্যের বৈপরীত্যের কারণেই তার ওপর আস্থা রাখতে পারি না। আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল প্রখর যুক্তির মানুষ, তাই যুক্তি দিয়েই তার ও তার সহযোগীদের কাছে জানতে চাই তার জোটের ইশতেহারে তিনি ঘোষণা দিলেন নির্বাচনে বিজয়ী হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পরই এ ইশতেহার ঘোষণার সময় তার পাশে বসে থাকা বিএনপি মহাসচিব, বিএনপির যে ইশতেহার ঘোষণা করেন সেখানে এ প্রসঙ্গে কিছুই নেই। কেন? ড. কামাল হোসেনদের কাছে কি এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে, বিএনপি তাদের পরীক্ষিত জোটসঙ্গী জামায়াতের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল, নতুন জোটসঙ্গীদের প্রতি ততটা নয়? ড. কামাল হোসেন এ কথা না বুঝলেও বা বুঝেও না বোঝার ভান করলেও দেশের মানুষ এ চাতুরীটি ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে, নিজেদের সংকটময় মুহূর্তে বিএনপির একটা মুখোশ দরকার ছিল। তারা যেভাবেই হোক ড. কামালের মুখোশটি ভাড়া করতে পেরেছে। ড. কামাল হোসেনের তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য ঢালটির আড়ালে যারা ঘাপটি মেরে আছে তারা যে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তা বোঝার জন্য গবেষণার দরকার নেই।
নির্বাচনী রাজনীতির নানা পর্যায়ে নানা পরিচিত চরিত্রের এমন ওলট-পালট আচরণ দেখে অভিনয় ও কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ফজলুর রহমান বাবুর গানটি খুব মনে পড়ল। বাবু লিখেছেন : ইন্দু বালাগো, তুমি কোন আকাশে থাকো, জোছনা কারে মাখো, কার উঠানে পড় ঝরিয়া? আমি এবং আমার মতো বিভ্রান্ত অনেকেরই প্রশ্ন : আমাদের রাজনীতির বহুল পরিচিত এ ‘ইন্দুবালা’দের আসল পরিচয় কী? তারা কোন আকাশে থাকেন, কাকে জোছনা মাখেন আর কার উঠানে পড়েন ঝরিয়া? এতসব প্রশ্ন কিন্তু ‘মেলে না জবাব’। রাজনীতির মাঠে বহুজনের আদর্শিক মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আবারও বাবুর কাছ থেকে ধার করে বলি : এরা মরিয়া ডুবিলেন, না ডুবিয়া মরিলেন সে প্রশ্নের জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের ফলাফলের জন্য।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক