নিউজ বাংলা ডেস্ক:

বাঁধাকপি কখনো দেখেননি বা খাননি, এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু শিশু বাঁধাকপি দেখেছেন বা খেয়েছেন কি? আদর করে যাকে ‘শিশু বাঁধাকপি’ বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, মূলত তার পোশাকি নাম ব্রাসেলস স্প্রাউট। আমাদের দেশে এটি একেবারেই নতুন হলেও শীতপ্রধান দেশের জনপ্রিয় সবজি। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরে গবেষণারত শিক্ষার্থী কাজী নওরিন বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রথমবার এই নতুন সবজির চাষ করে সফল হয়েছেন। শেকৃবির গবেষণা মাঠে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।

কী আছে এই কপিতে?
ব্রাসেলস স্প্রাউট কপি–গোত্রীয় সবজি, দেখতে বাঁধাকপির মতো। সাধারণত কপিজাতীয় সবজিতে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান বেশি থাকে। এতে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান গ্লুকোসিনোলেটসের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি আর সেই সঙ্গে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, এ এবং কে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।

ব্রাসেলস স্প্রাউট চাষাবাদপদ্ধতি অনেকটা বাঁধাকপির মতো। বীজ ও রোগবালাইও একই সবজির মতো। বীজ থেকে চারা বের হলে মূল জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়। লম্বা গাছের কাণ্ড থেকে সরাসরি পাতা বের হয়, প্রতিটি পাতার গোড়ায় বাঁধাকপির মতো দেখতে একটি করে ছোট কুঁড়ি বের হয়। এই কুঁড়ি বা বাড–এর নাম ব্রাসেলস স্প্রাউট। সাধারণত চারা লাগানোর দুই মাস পর থেকে গাছে স্প্রাউট আসা শুরু হয়। গাছের উচ্চতা ও জাতভেদে ২-৪ ফুট বা তারও বেশি হতে পারে। ফসলের জীবনকাল ৯০-১৫০ দিন। একটি গাছে ৪০-৬০টি স্প্রাউট হয়। গাছে যতগুলো পাতা থাকে, ততগুলো স্প্রাউট উৎপন্ন হয়। স্প্রাউটগুলো ৭-১০ সেমি আকারের এবং ওজন ৩০-৪০ গ্রাম হতে পারে। স্প্রাউট আসার ৩০-৩৫ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে এক-দুইবার গাছ থেকে স্প্রাউট তোলা যায়। ব্রাসেলস স্প্রাউটের রান্না প্রণালি বাঁধাকপির মতো হলেও এর স্বাদ ও গন্ধ কিছুটা আলাদা।

যেভাবে গবেষণার শুরু
কাজী নওরিন বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর মতো সহজ ও জানাশোনা বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন দ্রুত থিসিস পেপার জমা দিয়ে দেবেন। পছন্দের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তাঁর গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক, সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মানের সঙ্গে। কিন্তু কোনো বিষয়ই শিক্ষকের পছন্দ না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। আবুল হাসনাত চেয়েছিলেন, নওরিন আলাদা কোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা করুন। একদিন তিনি এই অচেনা সবজি নিয়ে গবেষণা করার প্রস্তাব দেন নওরিনকে।
নতুন কাজ; সফল হওয়া সম্ভব হবে কি না; যে সবজি বরফের দেশে জন্মায়, কম শীতের এ দেশে সেটি জন্মাবে বা বেড়ে উঠবে কি না, গাছের রোগ বা পোকামাকড় কীভাবে দমন করা হবে—এসব চ্যালেঞ্জের ভাবনা তাঁকে অস্থির করে তোলে। তার ওপর নতুন বাধা হয়ে দাঁড়ায় কয়েক দিন আগে ধরা পড়া বাতজ্বর, শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে মানসিকভাবে আরও দুর্বল করে ফেলে। সব মিলিয়ে ব্রাসেলস স্প্রাউট নিয়ে গবেষণা করবেন না বলে সরাসরি জানিয়ে দেন শিক্ষককে।
তখন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আবুল হাসনাত বোঝান তাঁকে। একরকম তাঁর ইচ্ছেতেই অনেকটা বাধ্য হয়ে গবেষণার এই বিষয় বেছে নিতে হয় নওরিনকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফসল উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মহি-উদ-দীন ইংল্যান্ড থেকে বীজ এনে দেন। কিন্তু বীজ পেতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। অক্টোবর মাসে বীজতলায় চারা গজানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মূল মাঠে চারা লাগিয়ে চলতে থাকে ধৈর্য পরীক্ষা। ‘একেকটা দিন যে কত লম্বা হতে পারে, তখন বুঝেছি। অপেক্ষা করা যে কী কঠিন, সেটা আগে বুঝিনি।’ বলছিলেন নওরিন। কপি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছিলেন, জানুয়ারিতে তাঁদের গাছ থেকে ফসল তোলা শুরু হলেও নওরিনের উৎপাদন ছিল প্রায় শূন্য।
ফেব্রুয়ারির দিকে অভিমান করেই কয়েক দিন মাঠে যাননি। নিজের অবস্থান ও বহুজনের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভেবেছিলেন, এই বিষয় নিয়ে আর গবেষণা না করে বাছতে হবে অন্য কোনো বিষয়। সময় যা নষ্ট হওয়ার হয়েই গেছে, আর নয়। নওরিন বলেন, ‘স্যারের কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় শেষে কান্নাকাটিও করেছি। কিন্তু নিজের লাগানো গাছের প্রতি তো একটা মায়া আছে। সেই যখন ফার্মে ফিরলাম, দেখি স্প্রাউটগুলো একটু একটু করে বড় হচ্ছে।’ তখনই কান্নার জায়গায় হাসি ফুটেছে তাঁর মুখে।

স্বপ্ন দেখার সাহস
তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে এসএসসি এবং ওয়েস্টার্ন কলেজ থেকে ২০১১ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন কাজী নওরিন। দুটোরই ফল জিপিএ ৫। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিষয়ে স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৭৬ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতে গবেষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ভাবতেন, কাজী পেয়ারার জনক বদরুদ্দোজা কাজীর মতো তিনি নামকরা বিজ্ঞানী হবেন। ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর সবার মতো আমিও বিসিএসের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। কারণ, আমাদের দেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়া খুব কঠিন।’ এখন গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে তাঁর। বলছিলেন, ‘আমার এই সফলতার পেছনে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান স্যারের অবদান সবচেয়ে বেশি।’
গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে নওরিনের মধ্যে সেই মানসিক দৃঢ়তা ও শক্তি আছে। সে পরিশ্রমী, উদ্যমী, নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। আমার ধারণাকে সে সত্য প্রমাণ করেছে।’
ব্রাসেলস স্প্রাউট উৎপাদনের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে নওরিনকে। এবার নতুন অপেক্ষা বাণিজ্যিকভাবে এই সবজি বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here