সৈয়দ তোসারফ হোসেন :
বাংলা নববর্ষ বেশ সাড়ম্বরে পালিত হলো। আবহাওয়া দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল যে বিকেলে ঝড়-বৃষ্টি হবে। কিন্তু সে পূর্বাভাস সত্য হয়নি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের যে পূর্বাভাস বিজ্ঞানীরা দিয়ে আসছিলেন তার আলামত ইতোমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। ঝড়-বৃষ্টির ধরণ পাল্টাতে শুরু করেছে। আমাদের সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগের দিনের ধ্যান-ধারণা, উৎসব আয়োজন আজকের ডিজিটাল যুগের সঙ্গে আর তাল রেখে চলতে পারছে না। উৎপাদনে, উপভোগে, উৎসবে বদল ঘটে চলেছে। অন লাইন বেচা-কেনা, ক্রেডিট কার্ডে দাম পরিশোধ ইত্যাদি বিষয়গুলো আগের দিনের হালখাতার সঙ্গে আর তাল রেখে চলতে পারছে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করে চলেছে। কয়েকটি শিল্প-বাণিজ্য পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে দেশের সমুদয় অর্থ-সম্পদ। ছোট-খাট কারবারীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। অর্থনীতিতে এই একচেটিয়া প্রবণতার দোষ-গুণ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা চলতে পারে কিন্তু একে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই। এমনটি চলতে থাকলে সমাজে সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকবে।
আগে বাঙালিরা ঘর কুনো ছিল। মাছের ঝোল আর বউ এর কোল ছেড়ে তারা বিদেশে যেতে চাইতো না। এখন তারা ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যেপ্রাচ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়া যেতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচে। এই মুহূর্তে এমন কোন দেশ নেই যেখানে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাক্ষাৎ মিলবে না। দেশ থেকে দেশান্তরে তারা ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করছে। তবে এই রেমিটেন্স নির্ভরতার ফলাফল ভাল হবে, না মন্দ হবে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। বিষয়টির ওপর সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন।
বাঙালি একটা শংকর জাতি। বিভিন্ন উৎস থেকে রক্ত এসে মিসেছে বাঙালির ধমনিতে। এই রক্ত তার চরিত্র বদলে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতোমধ্যে সমাজে নিষ্ঠুরতা বেড়েছে। আত্মহত্যা প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের পেছনে চলমান জীবনের বাস্তবতা কতটা দায়ী তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, আজকের দিনের সাংস্কৃতিক ভাবনার সঙ্গে টেকনোলজির কোন প্রকার সম্পর্ক থাকছে না। টেকনোলজী দ্রুত বদলে যাচ্ছে কিন্তু জীবন বদলাচ্ছে ধীর লয়ে। দুয়ের মধ্যে সঙ্গতি রক্ষার কোন চিন্তা করা হচ্ছে না। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে বিজ্ঞ জনরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
প্রকৃতির কোলে মানুষ বেড়ে উঠেছিল এবং বিকশিত হয়েছিল হাজার হাজার বছর ধরে। সময়ের ধারায় মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব ফলাতে গিয়ে আজ নিজের প্রজাতির জন্য সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রকৃতি ও পরিবেশবাদীরা শংকিত। রবীন্দ্রনাথ তার বলাকা কাব্যে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘আরতি দ্বীপ এই কী জ্বালা, এই কী আমার সন্ধ্যা? গাঁথবো রক্ত জবার মালা, হায় রজনী গন্ধা!’ রবীন্দ্রনাথ তার কাব্য চিন্তায় বাক বদল করার সময় কিছুটা দ্বিধায় ভুগেছিলেন। আর এ তো জানা কথা সময়ের ডাকে সাড়া দিতে গেলে স্বধর্ম নাশ হয়। তারপরও একে অনিবার্য বলে অনেকেই মেনে নেন। একে বিপজ্জনক মনে করলে সেক্ষেত্রে স্বধর্ম বজায় রেখে চলার পথ ও পন্থা নিয়ে ভাবতে হবে।
সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হবে আমাদের। গাছপালা, তরুলতা, পশু-পাখি, জীবজন্তু সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে হবে। দখলে-দুষণে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে আমরা টিকে থাকতে পারবো না। ভারতের নরেন্দ্র মোদীর কথাটি ধার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ।’
যা কিছু স্বাভাবিক বিকাশের অনুকূল তার সপক্ষে থাকতে হবে। নদ-নদীকে নর্দমার মতো ব্যবহার করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ট্যানারি শিল্প হাজারিবাগ থেকে সাভার সরিয়ে নেয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার দুষণ কমেছে। তবে সাভার থেকে দুষণ ছড়াতে থাকলে নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে। সে ব্যাপারে এখন থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ পরিবেশের পাপ ক্ষমার অযোগ্য।
বাংলা নববর্ষের প্রার্থনা হতে হবে অনন্ত আকাশে মাথা তুলে বাঁচার। উদার আলোক মাঝে উন্মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার।
সৈয়দ তোসারফ হোসেন: লেখক গবেষক ও প্রাবন্ধিক , সম্পাদক সাপ্তাহিক রোববার ।