চিররঞ্জন সরকার :
একথা ঠিক যে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। গরিবি কমছে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে, বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট হচ্ছে, চকচকে দালান-কোঠা, মেট্রোরেল, পদ্মা ব্রিজ হচ্ছে। এসবই উন্নয়নের সূচক। কিন্তু একটি দেশের উন্নয়নের যা প্রাণ সেই শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়নের চিত্রটা কেমন? এর উত্তরটা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। সরকার কেবল বছরের পর বছর বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার একশর কাছাকাছি দেখিয়ে বাহবা নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পাস করা এসব শিক্ষার্থীর পড়ালেখার মানের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়৷ ২৩ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যার দিক দিয়ে ‘সেঞ্চুরি’ করলেও পড়া-লেখার মান কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বিশ্বের শীর্ষ ৫০০টি উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এশিয়ায় রয়েছে ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে চীনের। এই তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়।ইউএস নিউজ ইউনিভার্সিটি কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বের উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং ২০১৯ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা সংস্থা ডাটালিডস। এই র‍্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকাণ্ড এবং বিশ্ব ও এশিয়া শিক্ষাবিদদের রেটিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। র‍্যাংকিংটি তৈরিতে ৭৫ দেশের ১,২৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

র‍্যাংকিং অনুসারে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মান সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হলো সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। বিশ্ববিদ্যালয়টি তালিকার ৩৮ নম্বরে রয়েছে। শীর্ষ ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এশিয়ার আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৪৯ নম্বরে রয়েছে সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি এবং ৫০ নম্বরে চীনের সিঙ্গুয়া ইউনিভার্সিটি। শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে জাপানের ইউনিভার্সিটি অব টোকিও (৬২), চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি (৬৮), সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটি (৭৬)।

চিররঞ্জন সরকার

বিশ্বের উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। দেশটির ১৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন। ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাদের পরে রয়েছে জাপান। ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এশিয়া তৃতীয় স্থানে আছে দক্ষিণ কোরিয়া।

এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতের ৪টি, সিঙ্গাপুরের ২টি এবং মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের ১টি করে বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় রয়েছে। উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যেসব দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই সেগুলো হলো বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ব্রুনেই, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মঙ্গোলিয়া (সূত্র: এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক)।

এমন তালিকার ভিত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে। ছাত্রদের পরীক্ষার ফল যেমন নানা বিষয় যোগ করে মোট নম্বর গুণে হিসেব করা হয়, এও অনেকটা তাই। পরীক্ষার নম্বরের বিচারকে ধ্রুবজ্ঞান করা, বিশেষত তার ভিত্তিতে ‘প্রথম বিশ’ বা ‘প্রথম একশো’ ছাত্রকে বাছা নিয়ে যে সঙ্গত আপত্তি আছে, এ ক্ষেত্রেও তা উঠতে পারে। তবু ছাত্রদের ক্ষেত্রে যেমন পরীক্ষার ফল মেধা বা অন্তত নিষ্ঠা মাপার একটা মোটা দাগের সূচক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তেমন ধরা যেতে পারে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কখনোই এই পরীক্ষায় তেমন এঁটে উঠতে পারে না। সর্বশেষ তালিকাতেও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো উল্লেখযোগ্য স্থান নেই। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ১৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এর কোনোটিই বিশ্বের সেরা ৫০০ এর মধ্যে নেই। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে?

আবার বলছি, এই তালিকা শিরোধার্য করার কারণ নেই। তবু এর ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্ত, কিছু প্রস্তাবের অবকাশ আছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। হতাশা আছে।

যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবক্ষয়গ্রস্ত হয়েছে অতিরিক্ত দলীয় রাজনীতির চর্চা আর দেশের নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার কারণে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা চর্চার চেয়ে অর্থনৈতিক লাভ বেশি গুরুত্ব পায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শিক্ষা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই।

আধুনিক জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি ভূমিকা পালন করে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান উৎপাদন করে, যা দেশ ও বিশ্বের কল্যাণে অত্যাবশ্যক। দ্বিতীয়ত, ওই সব জ্ঞানের বাস্তবায়নে দক্ষ-যোগ্য প্রশাসনিক নেতৃত্ব তৈরি করে। ক্লাসঘরে সারি সারি বসে থাকা মেধাদীপ্ত তরুণ ছেলেমেয়েকে বিশেষজ্ঞরূপে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। দেশের জনগণ নিজেদের সন্তানদের পায় সৃজনশীল মননে। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে একটি জনপদের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব উদ্ভাবন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গণমুখী অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দর্শন নির্ধারণ করে এবং সেসব বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা দেয়। দেশের মনীষা বিশ্বসমক্ষে ভাস্বর হয়ে ওঠে। সারা বিশ্বকেও কল্যাণের পথে নেতৃত্ব প্রদানে ভূমিকা পালনে সমর্থ হয় দেশ এবং বিশ্বে উচ্চপর্যায়ে আসীন হয় দেশের অবস্থান। এভাবেই দেশ এগিয়ে যায়, বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে, সভ্যতার পথে।

দেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এর মান বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতি বছর স্নাতক ডিগ্রি লাভকারীদের অন্তত ৭০ ভাগের মান সন্তোষজনক নয় উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলেছে, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ইউজিসির এক প্রতিবেদনে শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ ও জাতীয় উন্নয়নে মোট ২৮ দফা সুপারিশ পেশ করেছিল। এসব সুপারিশের মধ্যে ছিল মেধাপাচার রোধে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, সেশনজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্যাপ ব্যবসা বন্ধ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, উচ্চশিক্ষায় গলদ থাকায় বিপুলসংখ্যক গ্রাজুয়েট জাতির বোঝা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। শিক্ষাগুরু সক্রেটিস থেকে শুরু করে নিকট-অতীতের টোল পণ্ডিতরা জ্ঞান বিতরণের কাজকে ঐশ্বরিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু যুগ-পরিবর্তনের হাওয়ায় দৃশ্যপট আমূল পাল্টে গেছে। জ্ঞান বিতরণের কাজটি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং সেন্টার ইত্যাদির পর শিক্ষা-বাণিজ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা এক-একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে প্যাকেজ আওতায় জাতিকে জ্ঞান বিতরণের মহৎ কাজটি করে চলেছেন। জ্ঞানার্জনের উপায়, পদ্ধতি ও পরিবেশ যাই হোক না কেন, পকেটে যথেষ্ট অর্থকড়ি না থাকলে সেখানকার ছাত্রত্ব অর্জন করা যায় না।

দেশে পাসের হার বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। তবে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির অনুপাতে শিক্ষার মানের উন্নয়ন করা না গেলে এ থেকে কোনো সুফল পাবে না জাতি। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে অনেকেই কোচিং সেন্টারের আদলে বহুতল ভবনের একটি বা দুটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্যের পসরা খুলে বসেছে।

দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭০-এরও বেশি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর বেশির ভাগেরই না আছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, পাঠাগার ও গবেষণাগারসহ সমন্বিত পাঠদানের ব্যবস্থা, না আছে অবকাঠামোসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক এবং জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক উত্তীর্ণদের জানার ভিত দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। বাস্তবে যে এটিই ঘটছে।

গণতন্ত্রকে সংখ্যার প্রাধান্য রূপে গণ্য করতে অভ্যস্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পরিমাণ নিয়ে এতই ভাবিত যে, গুণগত উৎকর্ষকে সংখ্যার যূপকাষ্ঠে বলি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। তাইতো তারা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অকাতরে ছাড়পত্র দিয়েছেন। তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আকাশে উঠেছে, শিক্ষার মান কোন অতলে নেমেছে, তা জানতে তদন্ত কমিটি করা যেতে পারে। লক্ষণীয়, সামগ্রিক ভাবেই উচ্চশিক্ষার মানের সঙ্গে আমাদের দেশের সরকাগুলো গুরুতর আপস করে আসছে। এখানেই বঞ্চিত বাংলাদেশ। আজ বহুদিন ধরে।

এর পরেও আমাদের দেশে যতটুকু যা লেখাপড়া কিংবা জ্ঞান চর্চা হয়, যারা তা করে সেটা একান্ত নিজেদের গরজেই করে। বিধাতার খেয়ালে এই দেশে এমন উড়নচন্ডী ‘পাগলা কানাই’ অনেক জন্মায়, তাই কিছুতেই এখান থেকে লেখাপড়া নির্মূল করা যাচ্ছে না! আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা ঘিরে কী চরম অবহেলা ও ভ্রষ্টাচার চলছে-তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন।

শিক্ষার উন্নতি সমাজের একটা সার্বিক প্রক্রিয়া। এক মঞ্চে মার্গসঙ্গীত আর বাঁদরনাচ চলে না। তেমনই শিক্ষার নামে দলীয়করণ, নোংরা রাজনীতি, হিংসা, লোভ আর দুরাচারের অবাধ রাজত্ব কায়েম করব, আর শিক্ষার মান বাড়বে-তা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর প্রশ্নটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া উচিত। বিদ্যাবিরোধী, জ্ঞানবিরোধী মানুষজন এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নেবে না। আমলাতন্ত্র নির্ভর সরকারও ভরসার জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই ঘুম ভেঙ্গে উঠতে হবে। জেগে উঠে নিজেদের পথ নিজেদেরই দেখতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here