বিবিসি বাংলা:
বাংলাদেশ সরকারের চলতি অর্থবছরের অর্ধেকও এখনো পার করতে পারেনি। তবে এরই মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুরো বছরের জন্য সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে মোট ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পাক্ষিক প্রধান অর্থনৈতিক সূচকে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ০১ জুলাই থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ মাসের মধ্যেই সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বাজেটে টার্গেটের সিংহভাই নিয়ে বসে আছে। দ্রুতই হয়তো পুরো বছরের ঋণের লক্ষ্যমাত্রার পুরো টাকাটাই হয়তো নিয়ে ফেলবে। অর্থনীতিবিদরা সরকারের ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ফারিয়া নাইম বলেন, এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো আরো বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। “ঘাটতি মেটাতে এক বার দুবার ঋণ নেয়া যায়, বার বার নেয়া যায় না,” বলেন তিনি। ফারিয়া নাইম আরও বলেন, সরকারের ঋণ বেড়ে গেলে আরো যে সমস্যাটি প্রবল হয়ে দাঁড়ায় তা হলো ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের তহবিল পেতে সমস্যা হয়। ফলে বিনিয়োগ বাড়ে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে না। যার ফলে বাধাগ্রস্ত হয় সামগ্রিক অর্থনীতি।
“বিনিয়োগের ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে।” আর বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমার ঝুঁকি তৈরি হয়।
কেন এত বেশি সরকারি ঋণ
অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, জিডিপিতে ৫ শতাংশ হারে ঘাটতি হতে পারে এমনটা ধরে নিয়েই সাধারণত সরকারের বাজেট ঘাটতি হিসাব করা হয়। তিনি বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হছেনা বলে বাজেটেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হচ্ছে যে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কর আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকারও বেশি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৫৮ ভাগ বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন,অনেক সময় সরকারের মেগা প্রকল্প এবং নানা ধরণের উন্নয়ন প্রকল্প কাট-ছাট করা সম্ভব হয় না, ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়তে সরকারকে বাধ্য হতে হয়।
ড. সায়মা হক বিদিশা মনে করছেন, চলতি বছর আগে ভাগেই সরকার ঋণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে ফেলেছে বা আর কয়েক দিনের মধ্যেই পূরণ করে ফেলবে, ফলে বাজেট ঘাটতি পূরণে পরিকল্পনার চেয়ে আরো বেশি ঋণ নেয়া সরকারের দরকার হবে। “এ অবস্থায় ব্যয় কাট-ছাট করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর এ কারণে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ পড়ে যেতে পারে”।
এছাড়া, সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি টাকা নিয়ে নিলে ব্যক্তিগত খাতে ঋণের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ না পেলে অনেক সময় সরকারকে চড়া সুদে বিদেশি উৎস থেকেও ঋণ নিতে হয় যা পরবর্তীতে চাপ তৈরি করে। কারণ সেটা পরিশোধ আসলে দেশ এবং দেশের মানুষকেই করতে হয়।
একই ধরণের ঘটনা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও দেখা যায় বলে উল্লেখ করেন ড. হক। অতিরিক্ত ঋণ সেসব দেশের আর্থিক খাতকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে থাকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়া, সরকারি রিজার্ভে বড় ধরণের ধ্বস নামা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যমানে প্রভাব ফেলতে পারে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যা করতে হবে তা হলো সরকারের আয় বাড়াতে হবে,” বলেন ড. বিদিশা।
সম্পর্কিত বিষয়