নিউজবাংলা ডেস্ক :

১৩ শতকের বিখ্যাত এক মুসলিম কবি এবং সুফি তিনি। বলছি জালাল উদ্দিন রুমির কথা। তার জীবনবোধের কাছে বার বার ফিরে যাই, যখনই মনে হয় জীবনের স্বাভাবিক চলার পথে কোথাও আটকে গেছি। জীবনের বিবিধ জটিলতার বেড়াজালে সুফিজম কিংবা একজন মরমি কবির অন্তর্নিহিত উপলব্ধিগুলো কখনো কখনো সামনে তাকাবার জন্যে ভীষণভাবে দরকার হয়।

জালাল উদ্দিন রুমির হৃদয় ছোঁয়া ১২টি উপলব্ধির কথা জানাবো এই লেখায়।

১। প্রিয় শিক্ষক কিংবা প্রিয় বন্ধু অথবা আধ্যাত্মিক পথের সহচারী গুরু শামস তাবরিজির সাথে তার ছিল গভীর সম্পর্ক। শামস তাবরিজির মৃত্যুর পর বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছিলেন,

“তুমি চলে গেলে আমার চোখ দিয়ে রক্ত বাহিত হলো। আমি কেঁদে কেঁদে রক্তের নদী বহালাম। দুঃখগুলো শাখা-প্রশাখা বেড়ে বড় হলো, দুঃখের জন্ম হলো। তুমি চলে গেলে, এখন আমি কীভাবে কাঁদবো? শুধু তুমি চলে গেছো তা-ই নয়, তোমার সাথে সাথে তো আমার চোখও চলে গেছে। চোখ ছাড়া এখন আমি কীভাবে কাঁদবো প্রিয়!”

বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্কের বিচ্ছেদ অনুভূতির করুণ এক উপলব্ধি যেন ছিল এই লাইনগুলো…

২। প্রেমের সন্ধ্যান সম্পর্কে তিনি এমন করে বলেছিলেন,

“যদি তুমি চাঁদের প্রত্যাশা কর, তবে রাত থেকে লুকিয়োনা। যদি তুমি একটি গোলাপ আশা কর, তবে তার কাঁটা থেকে পালিয়োনা, যদি তুমি প্রেমের প্রত্যাশা করো, তবে আপন সত্তা থেকে হারিওনা।”

৩। জালাল উদ্দিন রুমির কাছে নাচ অনেকটা আরাধনার মতো ছিল। ঘোরের মধ্যে যেন চলে যেতেন। সৃষ্টিকর্তাকে খোঁজার এ একটা উপায় ছিল তার কাছে। তিনি বলতেন,

“আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে।
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে,
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।”

৪। ভালবাসা সম্পর্কে রুমি একটি গল্প শুনিয়েছেন। অনেকটা এমন-

“দুইজন মানুষ একে অপরকে ভালবাসে।
একজন তার প্রিয় মানষকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমার চেয়ে বেশি তোমার নিজেকে ভালবাসো? মানুষটা উত্তরে জানালো, আমি আমার কাছে মরে গেছি, আমি বেঁচে আছি তোমার মধ্যে। আমি আমার সবকিছু থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছি, অথচ আমি শুধু দৃশ্যত উপস্থিত আছি তোমার কাছে।

আমি ভুলে গেছি আমার সব জ্ঞান, তোমাকে জেনে আমার শিক্ষা পূর্ণ হয়েছে। আমি আমার ক্ষমতা হারিয়েছি কিন্তু তোমার শক্তিতে আমি বলীয়ান হয়েছি। আমি আমাকে ভালবেসেছি, তাই আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে ভালবাসি, তাই আমি আমাকে ভালবাসি।”

৫। ভালবাসাকে জালাল উদ্দিন রুমি সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছেন। তিনি উপদেশ দিয়েছেন এভাবে,

“যদি তুমি সত্যিকারের মানুষ হয়ে থাকো, তাহলে ভালবাসার পক্ষে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে বাজি ধরো। যদি না পারো, তাহলে এই কোলাহল ত্যাগ করো। কারণ, যার হৃদয় ভালবাসায় পূর্ণ না, সে কখনো গৌরবময় জীবনে পৌঁছাতে পারে না।”

৬। আজকের দিনে ভালবাসার স্থায়িত্ব এতো কম যে ভালবাসার চেয়ে বিচ্ছেদের গল্পই শুনি বেশি আমরা। ভালবাসায় কি আসলেই বিচ্ছেদ থাকে? রুমি বিচ্ছেদ নিয়ে বলেছিলেন,

“বিচ্ছেদ কেবল তাদের জন্যে যারা তাদের চোখ দিয়ে ভালবাসে। আর যারা ভালবাসে হৃদয় আর আত্মা দিয়ে, তাদের কাছে বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই।”

৭। কাউকে জাজমেন্ট করা, কি করা উচিত বলে জ্ঞান দেয়ার আগে নিজেকে সেই অবস্থানে দাঁড় করানো খুব কঠিন। রুমির এই সম্পর্কে উক্তি আছে এরকম-

“মোমবাতির মতো আলো দেয়া সহজ নয়। কারণ, অন্যকে আলোকিত করতে হলে আগে নিজেকে আগুনে পোড়াতে হয়।”

৮। আমাদের সবার ডেস্টিনেশন আলাদা। নিজের পথে তাই কাউকে না পেলেও হতাশ হয়ে কি লাভ, পথে তাদের সাথে দেখা হবে, কিন্তু তাদেরকে নিজের পথে, পাশে থাকার জোর আমরা করতে পারি না। কারণ, তাদের ডেস্টিনেশনও হয়ত আলাদা। রুমি বলেন,

“এই যে পথ, এই পথ তোমার, একার। অন্যরা হয়ত তোমার সঙ্গে হাঁটবে কিন্তু কেউই তোমার জন্যে হাঁটবে না।”

৯। আজকাল আত্মহত্যার খবর কত ছড়ায়। তারপর আশেপাশের মানুষ কি দরদি আচরণ করে, স্মৃতিচারণ করে। কেন আমরা জীবদ্দশতাকেই মানুষকে ভালবাসার কথা জানিয়ে দেই না? রুমি মৃত্যু পরবর্তী সময়ে মানুষের আচরণ নিয়ে বলেছেন,

“ভবিষ্যতে তুমি আসবে আর আমাকে স্মরণ করে হয়ত আমার কবরের গায়ে চুমু খাবে, তবে কেন এখনই নয়? এই যে আমি, সেই ভবিষ্যতের একই ব্যক্তি।”

অর্থাৎ, আমি বেঁচে থাকতেই আমাকে বলো আমাকে কি ভালবাসো তুমি অথবা আমার প্রতি তোমার কি অনুভূতি, আমি হারিয়ে গেলে সে কথা আমার কবরকে বলে কি লাভ!

১০। আমাদের জীবনের গোটা গল্পটাই যেন রুমি এই এক লাইনে বলে দিয়েছেন। এই উক্তি দিয়ে শেষ করি লেখাটা। রুমি বলেন,

“আমাদের জীবনের অর্ধেককাল কেটে যায় অন্যকে মুগ্ধ করার প্রচেষ্টায়, আর বাকি অর্ধেক কাটে অন্যের দেয়া দুশ্চিন্তার ভারে।”

(সংগৃহীত )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here