নিউজ বাংলা প্রতিবেদক
নবগঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টি কিংবা এবি পার্টির আত্মপ্রকাশের পর জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার মন্তব্যের পর দুই দলের মধ্যকার বিতর্ক প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মন্তব্য ও পাল্টা মন্তব্যে উভয় দলের নেতাকর্মিরা সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জামায়াত থেকে বেরিয়ে আসার পর নতুন দল এবি পার্টির প্রধান উদ্যোক্তা মজিবুর রহমান মঞ্জুকে বেঈমান মোনাফেক হিসেবে কটুক্তি করায় এবি পার্টির নেতাকর্মিরাও পালটা পালটি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
এবি পার্টি প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান ও দলের কট্টোরপন্থী ইসলামিক স্কলার হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক মফিজুর রহমানের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া বিতকর্কে আরো তুঙ্গে তুলেছে। এবি পার্টি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত প্রধান বলেন, ‘তাদের কর্মসূচী ও এজেন্ডায় ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ এ চ্যাপ্টার থাকবেনা। ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিয়েই হবে তাদের সবকিছু। ফলে আমাদের আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের ভাইয়েরা তাদের নিজেদের অবস্থা একেবারে স্পষ্ট করেছেন। দ্বীন তাদের সাবজেক্ট নয়, দ্বীনটাই আমাদের সাবজেক্ট। এতদিন তারা আমাদের প্রিয় ভাই ছিলেন, প্রিয় মানুষ ছিলেন। এখন কী করব তাদের ব্যাপারে।’
জামায়াত প্রধানের এই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে, এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা দলের ঘোষণাপত্রে বলেছি ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কের উর্দ্ধে রাখার কথা আর উনি বললেন, ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিয়েই হবে তাদের সবকিছু। এটা কি এক কথা হলো? উনার অবস্থান থেকে উনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিস্ময়কর এবং সত্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
লন্ডনে অবস্থানরত অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, মুনাফেক তো বড় সমস্যা সব যুগের, এরা নামাজও পড়ে, রুকনও হয়, শিবিরের কেন্দ্রিয় সভ্পাতি হয়, কিছুদিন পর কয় জাতীয়তাবাদ ভালো। কী জাতের মুনাফেক খোদার দীনের ভেতর লুকায়িত ছিল। তিন আবদুল্লাহ বিন ওবাইয়ের উদাহরণ টেনে বলেন, রসুলের যুগে মুনাফিক ছিল এ যুগে কি থাকতে পারবেনা? এটা একটা অশনিসংকেত। কি করে অন্তরের ভেতর কুফরি লুকায়িত রেখে এ সংগঠনকে নেতৃত্ব দিল। … যে দল ক্ষমতায় যেতে পারে না সে দলের সাথে তারা নাই, মুনাফিকির আর কি কিছু জানার বাকি আছে? জামায়াত যে হক জামায়াত নয় তার কি প্রমান আছে? সংগঠনের এই পর্যায়ে মাথার ভিতর পর্যন্ত বিষাক্ত বীজ আছে। কীভাবে যে ঢুকছে আল্লাহ তায়ালাই জানে। লন্ডনে আসার পর আমার সাথে দেখা হলো, আমি বললাম পঁচা ডিম তোরা । পঁচা ভাত ধুয়ে টুয়ে খাওয়া যায়, পঁচা ডিম আর খাওয়া যায় না। তিনি আরো বলেন, ‘এদের জন্য সকলকে মাস্ক পড়তে হবে যাতে জীবানু ঢুকতে না পারে। এদের থেকে দূরে থাকতে হবে। ছি ছি ছি! এই আন্দোলনের কলিজার ওপরে কীভাবে আঘাত করেছে।’
মফিজুর রহমানের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘অধ্যাপক মফিজুর রহমান আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন গুরু ও ওস্তাদদের অন্যতম। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি মন্দের মোকাবিলায় উত্তম আচরণ করার জন্য। বড়দের প্রতি সম্মান ও ছোটদের ক্ষমা-স্নেহ প্রদর্শনের বহু পাঠ তিনি দিয়েছেন। যত ক্ষতি’ই হোক, শত প্রতিক‚লতার মধ্যেও হক কথা বলার, জমিন ছেড়ে পালিয়ে না যাওয়ার তালিম তাঁর অন্যতম প্রধান শিক্ষা ছিল। তাঁর যে কোন মন্তব্য আমার জন্য দোয়া স্বরুপ।’
শীর্ষনেতাদের মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে দুই দলের নেতা কর্মিদের মধ্যে বাদানুবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে জামায়াত তার দলের অভ্যন্তরে স্বাধীন মতামতকে পাত্তা দেয়নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। দলের ভেতর সংস্কার প্রস্তাব ছিল দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতা কামারুজ্জামান কারাগারে থেকেই দলকে সংস্কারের তাগিদ দিয়েছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি একাধিক বিকল্পের মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নামও বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে চার বছর আগে দলের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে কামারুজ্জামান এসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতে কামারুজ্জামান নিজেসহ জামায়াতের আটক নেতাদের মৃত্যুদন্ডের আশঙ্কা এবং যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতের করুণ পরিণতি সম্পর্কে পূর্বাভাসও ছিল। তবে চিঠিতে পাকিস্তানের কারণে জামায়াতের গায়ে কাদা লেগেছে বললেও নিজেদের একাত্তর সালের কর্মকান্ডের বিষয়ে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেপ্তার হন কামারুজ্জামান। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে গোপনে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন তিনি। দলের উদ্দেশে লেখা ওই চিঠিতে কামারুজ্জামান মূলত জামায়াতের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে তিনটি বিকল্প উল্লেখ করে দ্বিতীয়টি গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তিন বিকল্প হলো:
এক. ‘যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব।’
দুই. ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।’
তিন. ‘আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তাঁরা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব। অর্থাৎ, একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি।’
নিজের তিন বিকল্পের ব্যাখ্যায় কামারুজ্জামান চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।’
জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ও জামায়াতের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি শামসুন্নাহার নিজামী ২০১১ সালের ১১ ও ২৫ মার্চ সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় দুই কিস্তিতে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। ‘বিবেচনায় আনতে হবে সবকিছু’-এ শিরোনামে লেখা ওই নিবন্ধে তিনি কামারুজ্জামানের চিঠির কিছু জবাব দেন।
নিবন্ধে তিনি বলেন, জামায়াত মনে করে, যেকোনো পরিস্থিতিতে বা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো কর্মকৌশল নয়, বরং শাশ্বত কর্মকৌশলই অবলম্বন করতে হবে। পরিস্থিতি যতই নাজুক হোক, চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক; শর্টকাট কোনো পথ নেই।
বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা হিসেবে পরিচিত কামারুজ্জামানের ওই সংস্কার প্রস্তাব দলের মধ্যে ব্যাপক আলোচিত হলেও কারাগারের বাইরে থাকা নেতারা বিষয়টি গণতান্তিক উপায়ে দলীয় ফোরামে এজেন্ডা হিসেবে না এনে বিস্ময়কর ভাবে তারা নীরব থাকেন। প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে কোনো মতামত দেন নি তারা । জনশক্তির মাঝে বিষয়টি তোলপাড় সৃষ্টি করলে শামসুন্নাহার নিজামী দলের গতানুগতিক অবস্থানকেই তুলে ধরেন। ফলে কামারুজ্জামানের এই প্রস্তাব শীর্ষ নেতাদের কাছে গৃহীত না হলেও জনশক্তির মাঝে এক বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে রয়ে যায়।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ বেশ কয়েকজন নেতা ছিলেন কামারুজ্জামানের প্রস্তাবের ঘোরতর সমর্থক। একাত্তরের ভ‚মিকা ও সংস্কারের বিষয়টি বহুদিন ধরেই দলের মাঝে আলোচিত সমালোচিত হয়ে আসছে, এখনও বিদ্যমান। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও মজিবুর রহমান মঞ্জুর নতুন দল গঠনের উদ্যোগ তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আগামীতে আরো বহু নেতা কর্মি নবগঠিত এবি পার্টিতে যোগ করবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তাছাড়া একটি আদর্শবাদী দল নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়ায় দলের মাঝে সুবিধাবাদিতার পথ উন্মুক্ত হয়েছে বলেও কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রামের একটি সংসদীয় আসন নিয়ে দুই জামায়াত নেতার মধ্যকার দ্ব›দ্ব তার উৎকৃষ্ট প্রমান বলে উল্লেখ করেন তারা।
২৮ শে অক্টোবর পল্টনে দলের নেতাকর্মীদের লগি বৈঠার তান্ডবের মুখে ঠেলে দেয়া, কাকরাইলে পুলিশের ওপর আক্রমন ও শত শত গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা নেতৃত্বের অপরিণামদর্শীতা বিবেচনা করেন অনেকেই। শক্তি প্রদর্শনের এই রাজনীতি দলকে বর্তমান সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে তাদের অভিমত। যে কারণে আত্মগোপনে থেকে দল পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছেন দলের নেতৃবৃন্দ।
নতুন রাজনৈতিক দল এবি পার্টির আত্মপ্রকাশের সাথে জামায়াত দলের সর্বস্তরে রেড এলার্ট জারি করেছে। জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করে মনিটর করছে কেউ এবি পার্টিতে যোগদান করছে কিনা। আরও কোনো শীর্ষ নেতার যোগদানের মধ্যদিয়ে জামায়াতে সাংগঠনিক ধস নামে কিনা তা নিয়ে জামায়াতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার শালীনতা না মেনে পোস্ট ও কমেন্টে লিপ্ত হচ্ছে অনেকে । ফলে জামায়াত এবি পার্টি এখন মুখোমুখি অবস্থানে।