নিউজবাংলা ডেস্ক:

নামের সঙ্গে নবাব জুড়ে দিয়ে প্রতারণার বিশাল ফাঁদ পাততেন হাসান আলী আসকারী নামের এক ব্যক্তি। নিজেকে নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর খাজা আমানুল্লাহ আসকারীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতেন এই প্রতারক।

আর তার সেই ভয়াবহ প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে ভুক্তোভোগী হয়েছেন শত শত মানুষ।

বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আলী হাসান আসকারীসহ তার প্রতারকচক্রের ৬ জনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসির ইকোনমিক ক্রাইম অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং টিম।

এরপরই বেরিয়ে আসে আসকারী ও তার চক্রের প্রতারণা করার অবাক করা সব চিত্র। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসকারী স্বীকার করেছেন তার ভয়াবহ সব প্রতারণার গল্প। জানিয়েছেন, কীভাবে নবাব সলিমুল্লাহর বংশধর সেজে অনেকের থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়েছেন।

পুলিশ জানায়, বছর পাঁচেক আগে নিজের নামের সঙ্গে খাজা শব্দটি যোগ করেন আলী হাসান আসকারী। নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর খাজা আমানুল্লাহ আসকারীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন এই প্রতারক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেকে নবাবের বংশধর হিসেবে প্রচারণা শুরু করেন।

শুরু করতেন নিজের ভূয়া বিত্ত-বৈভব ও নবাবের বংশধর পরিচয়ের জাহির।  তিনি সবাইকে বলতেন,তার বাবার একটি বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সঙ্গে শেয়ার রয়েছে তাদের।  যে কারণে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার কাছে ৭০০ নার্স চাইছে। নবাবের বংশধর হিসেবে অনেকেই আসকারীর এই ফাঁকা চাপাবাজি সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলত। তারা তাকে সে বাবদ টাকা দিত। টাকা নেয়ার পরপরই চেহারা পাল্টে ফেলতেন আসকারী। তাদের ফোন আর ধরতেন না। মোবাইল নম্বর ব্লকলিস্টে রাখতেন। কেউ বাড়াবাড়ি করতে চাইলে হত্যার হুমকিও দিতেন।

এভাবেই নবাবের বংশধরের পরিচয়ে লাখ-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অনেককেই সর্বশান্ত করেছেন আসকারী।

পুলিশ আরও জানায়, শুধু মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালই নয়;  পোলান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর নামেও টাকা নিয়েছেন আসকারী।

আর এসব প্রতারণায় তাকে সহযোগিতা করত ১০-১২ জনের একটি নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কটি তারই সৃষ্ট। নিজের এই প্রতারণার কাজকে আরও বিস্তৃতি দিতে চক্রটি গড়েছিলেন হাসান আসকারী। যাদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

তার এই চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতেন। তারপর কৌশলে এসব ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন আসকারী।

মানুষের সামনে নিজের বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতা প্রদর্শনে উদ্দেশ্যে ছবির আশ্রয় নিতেন আসকারী। তিনি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রোগ্রামে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন। সেসব ছবি প্রচার করতেন ফেসবুকে। এটিই ছিল মূলত তার প্রতারণার হাতিয়ার।

পুলিশ জানায়, রাজনীতিবিদদের পাশে দাঁড়িয়ে তোলা সেসব ছবি দেখিয়ে নানা প্রতারণার আশ্রয় নিতেন আসকারী। এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে সখ্য আছে বলে মানুষকে বিভিন্ন চাকরি পাইয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দিতেন। হাতিয়ে নিতেন মোটা অংকের টাকা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন বলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েও হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার নাম ভাঙাতেন তিনি।

এভাবে আব্দুল আহাদ সালমান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকেই সোয়া তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ভুক্তোভোগী জানান, ফেসবুকে পরিচয়ের পর আসকারী নিজেকে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। ক্ষমতাসীন দলের অনেকের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে বলে জানান আসকারী। আসকারীর ফেসবুক প্রোফাইলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি দেখে সে কথা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন সালমান। সালমানের উদ্দেশ্যে টোপ ফেলেন আসকারী। তার মাদ্রাসায় বিপুল অঙ্কের টাকা দান করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন আসকারী।

এসব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই আসকারী তাকে জানান, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার বাবার অংশীদারিত্ব রয়েছে। হাসপাতালে ৭০০ নার্স নিয়োগ করা হবে। তাকে কিছু কর্মী দিতে বলেন। বিনা খরচে এসব লোকজনকে বিদেশে পাঠানো হবে বলে জানান।

আসকারীর কথা বিশ্বাস করে এলাকা থেকে ৪০০ লোক সংগ্রহ করেন সালমান। তাদের প্রত্যেককে মেডিকেল করতে হবে বলে প্রত্যেকের সাড়ে ৮ হাজার টাকা করে খরচ নেন আসকারী। এভাবে সালমানকে মোহাম্মদপুরের ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন আসকারী। পরে প্রত্যেককে একটি করে নার্সিং সার্টিফিকেট ম্যানেজ করে দেবেন বলে প্রত্যেক সার্টিফিকেটের বিপরীতে ৭৫ হাজার টাকা করে দাবি করেন আসকারী। দাবি মোতাবেন, সালমান থেকে কয়েক দফায় মোট সোয়া ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন আসকারী।

এরপর থেকেই আসকারী রূপ পাল্টে টালবাহানা শুরু করেন। পরে সালমান বুঝতে পারেন যে, এলাকার ৪০০ লোকসহ তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

বুধবার প্রতারত আসকারীসহ গ্রেফতার হয়েছে তার ৬ সহযোগী – রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা, মীর রাকিব আফসার, সজীব ওরফে মীর রুবেল, আহম্মদ আলী ও বরকত আলী ওরফে রানা।

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নবাব পরিবারের অ্যামবুশ সিল, ওয়াকিটকি সেট, বেতার যন্ত্র, ভিওআইপি সরঞ্জাম, ল্যাপটপ, একাধিক মোবাইল, সিমকার্ড, মেডিকেল রিপোর্ট, পাসপোর্টের কপি ও বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানির লিফলেট উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসকারী স্বীকার করেছেন, তার এই প্রতারণার কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিল রাশেদ রাশেদ, আহাম্মদ ও বরকত। এরা তাই আপন তিন ভাই। বড় ভাই আহাম্মদ তার ম্যানেজার ছিল। রাশেদকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। আর ছোট ভাই বরকতকে বডিগার্ড বানাতেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here