দিলরুবা শরমিন:
মুক্তিযুদ্ধ মানেই আমার কাছে একটা বড় লাল টিপ, ভীষণ ভয়াবহ শব্দ, গাঢ় অন্ধকার আর হঠাৎ বিমান থেকে কিছু কাগজ উড়ে আসা! এক ধরনের শিহরণ। মাথা থেকে নেমে যাওয়া একটা বিশেষ ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি। কখনো হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়া এক অজানা ভালোলাগা।
অথবা মনে পড়ে হঠাৎ আমাদের আশ্রম রোডের বাড়ির মূল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমার মা দরজা খুলছেন। একরাশ লম্বা কালো চুলের, লম্বা দাড়ির সঙ্গে চটের বস্তার পোশাক পরা এক ফকির টাইপের মানুষ। জংলি চেহারা। খালি পা। কেমন যেন বুনো বুনো চেহারা। তার মাঝেই ঝকঝকে দুটো অসাধারণ চোখ!
‘মা, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি শিবলী। তোমার ছেলে।’ আমার মা ঝাপসা চোখে তাকিয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু সেই প্রথম আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছিলাম আমার ভাই। আমার পিতার সমান। একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। গেরিলা যোদ্ধা।
কবে যে নয় মাস পার হয়ে গিয়েছে সেটা আসলে জানিনি। এতটাই ছোট ছিলাম যে কবে শুরু আর কবে শেষ সেটা মনে নাই। ছোট্ট শিশু সন্তানদের নিয়ে আমার মায়ের যুদ্ধ তো আজীবন সঙ্গী।
কবে আমার ভাই যুদ্ধে গেল মনে নাই। টুকরো স্মৃতির ক্ষমতাবলে মনে করি, আমাদের বড় ভাই একদিন হঠাৎ খুলনা থেকে এলো সেদিনই যশোরে ভীষণ বোমা বর্ষণ! আমাদের কোনোমতে জাপটা করে ধরে ভাই বাসার পেছনের বাগানে পালাল। ভাই ফিসফাস করে বলেই চলেছিল চুপ চুপ চুপ! একদম চুপ। শিবলী যে যুদ্ধে গিয়েছে এটা ওরা জেনে গিয়েছে। আমাদের পেলে কাউকে রাখবে না। আমরাও ভাইর বুকের সঙ্গে লেপ্টে ছিলাম। ভাই, যার প্রথম সন্তান আমারই বয়সী প্রায়। ছুটে এসেছিল আমাদের নিয়ে যেতে। অতি সুদর্শন আমার এই ভাই ব্যাংকার। স্বভাবে আদবে কায়দা কানুনে মুগ্ধ হবার মতো। স্ত্রী পুত্রকে রেখে যে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি এই গ্লানি যাকে আজীবন কুরে খেয়েছে সে আমার মেজ ভাইকে দেখত পীরের মতো! কারণ সে মুক্তিযোদ্ধা।
ছেলে যুদ্ধে গিয়েছে তার জন্য নির্যাতিত হয়েছে আমার মা বোন ভাই! ভর্ৎসনা শুনেছে আত্মীয় স্বজনরা! সহজে কারও বাড়ি আমাদের জায়গা হয়নি। নানু অনেক কষ্টে রেখেছিলেন তার বিশাল অট্টালিকার পেছন দিকের দালানে। তাও খুব বেশিদিন নয় কারণ সব সময় টিকটিকি আমাদের পেছনে লেগেই থাকত। বিশেষ করে রেল রোডের কাশেম। এখন যে কি না বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। সব সময় আমার ভাইকে আর আমাদের কে ফলো করে পাকিস্তানিদের সংবাদ দেয়াই ছিল যার প্রধান কাজ।
আর সেই সূত্র ধরেই আমরা ছুটে বেরিয়েছি পথে প্রান্তরে। এখানে সেখানে। একবার তো এক রাজাকারের বাড়িতেও সকলে আটকে পড়েছিলাম। আমার মায়ের বুদ্ধির জোরে আমরা সবাই বেঁচে যাই। বিশাল বাড়ি। অনেক মানুষকে জায়গা দিয়েছিল। আমার মায়ের খুব বই পড়ার নেশা। সেই নেশায় সে ছুটে গিয়েছিল মাঝরাতে সেই বিশাল অট্টালিকার একতলার ঘরে। আর সেখানে গিয়েই নাকি সব স্বচ্ছ হয়ে যায়Ñ বিশাল পরিকল্পনার কথা! চক্রান্তের কথা। এভাবেই নাকি সবাইকে জায়গা দিয়ে একে একে তুলে দিচ্ছে রাজাকারদের হাতে! মা সেই রাতেই যতজনকে পেরেছিল জাগিয়ে পার হয়ে যায় আমাদেরও নিয়ে।
এমন কত যে ঘটনা! আমার মামারা বরাবর আভিজাত্য- বংশমর্যাদা আর ধন দৌলতের মোড়কে আবর্তিত। নির্ঞ্ঝাট এই পরিবার নিজেরদের নিয়ে ছাড়া আর কাউকে নিয়েই কখনো ভাবেনি। রাজরক্ত প্রবহমান শরীর এই সব মুক্তিযুদ্ধকে বড়জোর একটি ঘটনাই মনে করত। তার মাঝে মেজ ভাই গিয়েছে যুদ্ধে তাও আবার গেরিলা এটা হজম করা অনেক কঠিন বিষয় ছিল তাদের জন্য। আমরা ছিলাম বোঝার ওপর শাকের আঁটি!
তার মাঝেই আমার মায়ের যুদ্ধ ঘরে এবং বাইরে। আমাদের নিয়ে আবার আমার ভাইকে নিয়ে। কী ভয়াবহ দিন সে কি আর আমি বুঝেছি? আমি নাকি আমার নীল কাপড়ের পুতুল সামলাতেই ব্যস্ত ছিলাম! কিন্তু সব টের পেলাম যখন আমার ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন পতাকা হাতে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল! আমাদের না হয় চেনার কথা নয় কিন্তু মা? তার নিজে ছেলেকে চিনতে পারল না?
পারেনি। কারণ যেদিন যশোর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ গেরিলা বাহিনী আক্রমণ করল সেইদিন অনেক যোদ্ধাই আত্মাহুতি দেন। শহীদ হন। আর আমার ভাই? বিশাল প্রাচীর ঘেরা টেলিফোক এক্সচেঞ্জের দালানে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ে বোমামুক্ত হয়। প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু আমার মায়ের কানে এসেছিল শিবলী আর বেঁচে নাই। মা আমাদের কাউকেই বুঝতে দেয়নি তবে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছিল। নইলে যখন আমার ভাই দরজায় কড়া নেড়ে বলল তখন মা ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল কেন?
নানু বাড়ির শেষের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে মিত্র বহিনীর বিমান উড়ছে আর কি সব টুকরা কাগজ ফেলছে। এই অসাধারণ দৃশ্য দেখার জন্য আর কাগজ কুড়ানোর জন্য আমরা যখন নানু বাড়ির ছাদে কিলবিল করছি তখন মা কি উদাস ছিল? মনে নাই। লক্ষ্য করিনি। আমরা ছিলাম নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য শিশু আর মেজ ভাই তো মাকে বলেই গিয়েছিল যাচ্ছি মা। আর কোনো দিন দেখা না হলে ভুলে যেও। মনে করে কষ্ট পাবে না একদম। লক্ষ মা তার ছেলেকে হারাবে কিন্তু দেশ স্বাধীন হবেই। মা ছেলের এই বিদায় দৃশ্য কি কেউ কল্পনা করতে পারে?
আমার মেজ ভাই আমার পিতার অধিক! ফিরে এসেছিল জীবিত। ভগ্ন স্বাস্থ্য। ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে। মেজর মঞ্জুর ছিলেন তার ফোরসের লিডার। কিন্তু তিনি তো অনেক পরের কথা তার মাঝে কত না ঘটনা ঘটেছে!
মেজ খালাম্মার অপরূপ সুন্দরী মেয়ে শাহীন আপা হঠাৎ বলল, ‘আয় তোদের সবার কপালে একটা করে বড় লাল টিপ পরিয়ে দিই।’ আমরা ছোটরা সারিবদ্ধভাবে বড় বোনের আদেশ পালন করলাম। কিন্তু কেন সেটা তখন জানতাম না। সেই বলল, ‘আজ থেকে আমরা স্বাধীন। আমরা স্বাধীন সূর্যের মতো বড় লাল টিপ পরে জয় বাংলা বলে চিৎকার দেব।’ তখন কি সে জানত একদিন এই জয় বাংলা স্লোগান আবার পাকিস্তানি স্টাইলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ হয়ে যাবে?
যেমন আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই জানতো না কেবল মহান মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল বলে জেনারেল জিয়া তার ওপর চালাবে অমানবিক নির্যাতন। এমনকি তাকে না পেয়ে জিয়ার বাহিনী রাতের অন্ধকারে আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবে বাসার পাশের জঙ্গলে। বেছে বেছে সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন এর ইতিহাস এর পুনরাবৃত্তি কে না করেছে? যখন এরশাদ এলো ক্ষমতায় তখন আবারও সেই একই ঘটনা। জিয়া বা এরশাদের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা কি আমরা ভুক্তভোগীরা ভুলে গিয়েছি?
আজ আমার ভাই চরম অসুস্থ। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা চলবে অন্তহীন। এখন তার বয়স ৬৮। বিয়ে করেনি দেশের জন্য। আমাদের জন্য। আমি যখন তাকে নিয়ে সঠিক চিকিৎসার জন্য পাগলের মতো এখানে সেখানে ছুটি সে তখন খুব হতাশ হয়ে শিশুর মতো আমার কাছে জানতে চায় আমি বাঁচব তো? তার এই প্রশ্নের সদুত্তর আমি দিতে পারি না। একটু ঘুরিয়ে তাকেই প্রশ্ন করি তুই না মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধারা কি কোনোদিন মারা যায়? আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয় আমার ভাই। আবার বাঁচার সাধ জাগে। আমার হাতে তার মোবাইল ফোনটা তুলে দিয়ে বলে, মেমোরি কার্ড কিনে দিবি? গান শুনবো।
হাসন রাজা লালন শাহ- রবীন্দ্রসঙ্গীত পুরনো দিনের গান, মুক্তির গান! কত শখ তার আবার ফিরে যাবে যশোর। তার নিজের ঘরে। আবার তার সেই নিঃসঙ্গ জীবন। চিকিৎসক ভালো ব্যবহার করলে তিনি ভয় পান। আমরা সবাই তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আমি বাঁচব তো? একজন গেরিলা যোদ্ধার বাঁচার সে কী আকুতি! আহ! চোখ ভিজে আসে।
আমি বলি বাংলাদেশ যতদিন আছে মুক্তিযোদ্ধারাও ততদিন বেঁচে থাকবে সসম্মানে!
দিলরুবা শরমিন: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী