এ কে এম শাহনাওয়াজ 

প্রাচীন রোমের স্টোয়িক দার্শনিক সেনেকা বলেছিলেন, ‘ইতিহাসকে কখনো অস্বীকার করা যায় না, যারা করে তারা নির্বোধ।’ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায়-ইতিহাসের প্রতি তার নিষ্ঠা কত প্রবল ছিল। তরুণ বয়স থেকে তার রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি বাঁক তিনি সন, তারিখ দিয়ে এবং সব ঘটনা ও বিচিত্র চরিত্রকে ডায়েরিতে যুক্ত করে ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখকের পথ অনেকটা সুগম করে গেছেন। অথচ আমরা এ সময় ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমে ঐতিহ্যের শক্তি হারিয়ে ফেলছি।

গানে একটি কলি বারবার এসেছে, তা হচ্ছে ‘প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজধানী (সোনারগাঁও)।’ বুঝলাম, ইতিহাস জানার দুর্বলতা এখানেও ছেয়ে গেছে। তবে খারাপ লাগল একটি দায়িত্বশীল জায়গা থেকে গানটি নির্মাণ করা হয়েছে; অথচ সেখানে বড়দাগে ইতিহাসের ভুল থেকে গেল। এই গানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন গীতিকার, সুরকার, বেশ কজন শিল্পী, জেলা প্রশাসক এবং হয়তো সাংস্কৃতিক জগতের আরও কিছুসংখ্যক মানুষ। তাহলে কারও কাছে কি সাধারণ ইতিহাস বিচ্যুতিটি ধরা পড়ল না! বাংলার ইতিহাসের যুগ বিভাজন গীতিকার এবং অন্যদের চিন্তায় জায়গা করে নিতে পারেনি। প্রাচীন বাংলা নয়, সোনারগাঁও হচ্ছে মধ্যযুগের বাংলায় স্বাধীন সুলতানদের অন্যতম রাজধানী (আরও আগে থেকে রাজধানী ছিল গৌড়)।

প্রচীন বাংলার প্রথম রাজধানী বললে বলতে হয় খ্রিষ্টপূর্ব যুগে পুন্ড্রনগর-আজকের মহাস্থানগড়। আর প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাংলারাজ্য বিচার করতে গেলে এগারো শতকের মাঝপর্বে প্রতিষ্ঠিত সেন রাজাদের রাজধানী বিক্রমপুর। সেনদের সময় সোনারগাঁও বিক্রমপুরের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল, যার প্রশাসক ছিলেন দনুজ রায়। তখন সোনারগাঁও নামটি পাওয়া যায় না। নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম। সুলতানি আমলে ফারসি লেখকদের উচ্চারণে সুবর্ণগ্রাম হয়ে গেল ‘সুনারকাওন’। এর অপভ্রংশ হয়ে রূপান্তরিত হলো সোনারগাঁও।

গানটিতে আরেকটি ইতিহাস বিচ্যুতি রয়েছে। বলা হয়েছে-পানামনগর আর ঈশা খাঁর কথা। ছবি দেখানো হয়েছে পানামনগর আর সরদার বাড়ির। আমি দেখেছি, সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো ঈশা খাঁর রাজধানীর স্মৃতিবহ ইমারত বলে পরিচিত। অথচ এসব স্থাপনা ঈশা খাঁর মৃত্যুর প্রায় ৩০০ বছর পরের। ঈশা খাঁর রাজধানী বর্তমান সোনারগাঁওয়ে কখনো ছিল না। রূপগঞ্জ উপজেলায় কত্রাভু বলে একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ দুর্গের সঙ্গে ঈশা খাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে মনে করা হয়। ঈশা খাঁ মারা গেলে বারোভূঁইয়াদের নেতা হন তার ছেলে মুসা খাঁ। মুসা খাঁর রাজধানী হিসাবে সোনারগাঁওয়ের কথা কোনো কোনো তথ্যসূত্রে পাওয়া যায়। তবে সে সময়ের কোনো স্থাপনা শনাক্ত করা যায়নি। আমরা আশা করব, ইতিহাস রক্ষা করে গানটি নতুনভাবে নির্মিত হবে।

২.

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রাজ্ঞজনরাও অনেক ভুল ইতিহাসের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। যেমন, ছেলেবেলা থেকে পড়েছি-‘বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়’ কথাটি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ ধারার প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়েছে। এমএ ক্লাসের ছাত্র যখন, তখন আমার মনে প্রথম প্রশ্ন এলো-বখতিয়ার কেমন করে বঙ্গ বা বাংলা বিজেতা হতে পারেন? কারণ, বাংলা স্বাধীন রাজ্যের মানচিত্রে আসে ১৩৫২ সালে। বখতিয়ার নদীয়া দখল করেন ১২০৪ সালে। এটি বাংলার পশ্চিমাংশের একটি সীমান্ত অঞ্চল।

এরপর ১২০৫-এ দখল করেন উত্তরাংশের লখনৌতি। ১২০৬-এ পশ্চিম দিনাজপুরের দেবকোটে রাজধানী স্থাপন করেন। এ বছর এখানেই তিনি নিহত হন। তাহলে তিনি বঙ্গ বিজেতা হবেন কেমন করে! প্রাচীনকালে ‘বঙ্গ’ একটি জনপদ ছিল বটে; কিন্তু তা বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চলের বাইরে। বখতিয়ারের আগমনের পরে পূর্ববাংলা আরও প্রায় ২৫ বছর সেন রাজাদের অধীনে ছিল। তাই কোনো বিবেচনাতেই বখতিয়ার খলজিকে বঙ্গ অথবা বাংলা বিজেতা বলা যায় না।

এ নিয়ে ১৯৯০ থেকে লেখালেখি করেও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি। ১৯৯৬ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে কারিকুলামে পরিবর্তন আনে। সে সময় বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করার সুযোগ পাই। নবম-দশম শ্রেণির মানবিক শাখার ইতিহাস বইয়ের সংস্কার, পাঠক্রম তৈরি ও বই লেখার দায়িত্ব গ্রহণ করি। ১৯৯৬-এ প্রকাশিত এই বইয়ে প্রথমে আমি বখতিয়ারের বঙ্গবিজয় নির্বাসন দিয়ে নদীয়া ও লখনৌতি বিজয় ব্যবহার করে ইতিহাসকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম। এর পরের বছর দায়িত্ব পেয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামের বইয়েও একইভাবে সংস্কার করি।

কিন্তু দুঃখজনক পর্যবেক্ষণ হলো এই-২০১১ সালে এনসিটিবি নতুন শিক্ষানীতির আলোকে কারিকুলামে কিছুটা পরিবর্তন আনে। এই কাজেও যুক্ত ছিলাম। বই রচনা ও সম্পাদনাও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু জানলাম-বই ছাপার আগে নাকি একটি ঝড় উঠেছিল এনসিটিবিতে। ঝড় সামাল দিতে বই সম্পাদনার জন্য একটি প্রভাবশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা হয়তো বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছেন-তাদের চির জানা বখতিয়ার খলজির ‘বঙ্গবিজয়’ কথাটি নেই। তার বদলে ‘ভুল করে’ নদীয়া ও লখনৌতি বিজয় লেখা হয়েছে। তাই নিজগুণে সংশোধন করে দিয়েছেন।

পুনঃমূষিকের মতো আবার ছাপা হলো ‘বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়’। একই রকম ভুল আরেকটি আছে আমাদের ইতিহাস বইয়ে। অধ্যায় লেখা হচ্ছে ‘আকবরের বাংলা বিজয়’। অথচ সম্রাট আকবরের জীবদ্দশায় পূর্ববঙ্গ মোগলদের অধিকারে আসেনি। কতটা ইতিহাস বিচ্ছিন্ন আমরা! ইতিহাসের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের প্রতি নজর রাখার সুযোগ হয়নি ইতিহাস বিশেষজ্ঞদেরও!

৩.

আমাদের ইতিহাস বইয়ে ছোট-বড় এমন অনেক ভ্রান্তি রয়েছে, যা প্রতিদিন আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে এই লেখাটি শেষ করতে চাই। ষোলো-সতেরো বছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল: ‘বেগমের খোলসে অবরোধবাসিনী রোকেয়া’। তথ্যসূত্র দিয়ে বলার চেষ্টা ছিল-মহীয়সী রোকেয়াকে ‘বেগম রোকেয়া’ বলায় ইতিহাসে সংকট তৈরি হচ্ছে, হবে।

যদিও সম্মানিত মুসলিম মহিলার নামের আগে ‘বেগম’ ব্যবহারের রেওয়াজ রয়েছে; কিন্তু বহু এবং ভুল ব্যবহারে এখন তা রোকেয়ার নামের অংশ ভাবতে পারে প্রজন্ম। কারণ, আমাদের সমাজে এখন অনেক মেয়ের নাম ‘বেগম’ রাখা হয়। প্রজন্মের এমনও ভাবনার অবকাশ থাকতে পারে-রোকেয়া কেমন নারীমুক্তির অগ্রদূত, যিনি নিজের নামের সঙ্গে স্ত্রীবাচক ‘বেগম’ শব্দটি জড়িয়ে রেখেছেন! অথচ এই দায় কি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের?

গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে রোকেয়া ‘রুকু’ বা ‘রোকেয়া’ ব্যবহার করেছেন। নিজের সাহিত্য রচনায় নাম লিখতেন ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’। স্কুল পরিচালনা করতে দাপ্তরিক চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন আর.এস. হোসেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লেখার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে।

তিনি নিজেই লিখেছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত হওয়ার পথে দুজন পুরুষের কাছে তিনি ঋণী। একজন বড়ভাই ইব্রাহীম সাবের, যিনি সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে গভীর রাতে বোনকে প্রদীপ জ্বালিয়ে ইংরেজি শেখাতেন। অন্যজন স্বামী সাখাওয়াত হোসেন, যিনি মেয়েদের স্কুল খোলার ক্ষেত্রে স্ত্রীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে মৃত্যুর আগে দশ হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন। রোকেয়া বুঝিয়েছিলেন, মহৎ কাজে সাফল্য পেতে নারী-পুরুষকে পাশাপাশি এগিয়ে যেতে হয়।

অনেকে তর্ক করতে পারেন ‘বেগম রোকেয়া’ শব্দযুগল তো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে; তা নিয়ে আর বিতর্ক তোলা কেন! আমি তাদের সবিনয়ে বলব, ইতিহাসের ভুল যে কোনো সময়েই সংশোধন করা বাঞ্ছনীয়।

আমি স্যালুট জানাই সেই বিজ্ঞ অগ্রজদের, যারা একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের নাম রেখেছিলেন নিরাভরণ ‘রোকেয়া হল’। এই নামে কারও কি বুঝতে অসুবিধা হয় যে, তিনিই আমাদের মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন? মুসলিম মহিলাকে সম্মান জানাতে যেমন ‘বেগম’ ব্যবহার করা হয়, তেমনি পুরুষের নামের সামনে ‘জনাব’ ব্যবহারের রেওয়াজ আছে। এই সূত্রে আমরা যদি শাহবাগ মোড়ের মেডিকেল কলেজের নাম লিখি ‘জনাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’ তাহলে শুনতে কেমন শোনাবে? অবশ্য কাগজে আমার লেখাটি প্রকাশের পর সেসময় তেমন প্রতিক্রিয়া হয়নি গুণিজনদের মধ্যে। দু-একজন তির্যক চোখে তাকিয়েছিলেন।

এখন রোকেয়া প্রসঙ্গের উপসংহার টানি। কলকাতায় রোকেয়া চর্চার একটি সরব সংগঠন আছে। রোকেয়া ইনস্টিটিউশন অব ভ্যালু এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (রি-ভা-র)। এ সংগঠনের কর্মীরা নারীজাগরণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পশ্চিম বাংলার মেয়েদের স্কুল-কলেজে ছাত্রীদের মধ্যে রোকেয়াচর্চা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

এ সংগঠনের অন্যতম সংগঠক প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় টেলিফোনে আমার অনুমতি নিয়ে লেখাটি কলকাতার কাগজে ছেপেছিলেন। পরে কলকাতায় তাদের অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে যেতে হয়েছিল। তারা আমাকে চমকে দিয়ে জানালেন-তারাও তাদের বইপত্র কাগজে এতদিন ‘বেগম রোকেয়া’ লিখেছেন। আমার লেখার যৌক্তিকতা মেনে তারা সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর ‘বেগম’ ব্যবহার করবেন না।

আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে মহীয়সী রোকেয়ার জন্মভূমির দিকে তাকালাম। দেখলাম, রংপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে-যার নাম রাখা হলো ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’। বছর দুই আগে আমার হাতে একটি স্মরণিকা এলো। রোকেয়া দিবসে প্রকাশ করেছে সম্ভবত নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেখানে আদ্যোপান্তই বেগমের ছড়াছড়ি।

আমার জানামতে, শিক্ষাদীক্ষায় বিশ্বে এগিয়ে থাকা দেশগুলো সব ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীর জন্য ইতিহাস শিক্ষাকে আবশ্যিক রেখেছে। ইতিহাস হচ্ছে নিজেকে জানার আয়না। তাই ইতিহাসে যদি বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে অসত্যের মধ্যে বসবাস করতে হবে। বিভ্রান্ত হবে প্রজন্ম। ইতিহাসচর্চা-বিচ্ছিন্নতা জাতির এগিয়ে চলার পথকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তুলে। ভুল আর মিথ্যাকে শক্তিশালী করে। অতীত বাস্তবতা না জানলে বর্তমানের চলার পথ মসৃণ হয় না; আর ভবিষ্যৎ চলার পথকেও নিষ্কণ্টক করা যায় না।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here