সুজন বিশ্বাসঃ
তখন ছোট ছিলাম। তখনো বিশ্বকাপ ফুটবল ছিল, ছিল আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সাপোর্টার। তবে প্রযুক্তির এত উৎকর্ষ তখন ছিল না। সেসময় প্রতিদিন বিকেলবেলা মাঠে খেলতে যেতাম। মোবাইল ফোন ছিল না বলে সবার জন্য মাঠে উপস্থিত হওয়ার একটা সময় দেওয়া থাকত। সবাই ঠিক সময়েই যার যার কাজকর্ম সেরে মাঠে হাজির হতো। এতে সবার মাঝেই সময়ানুবর্তিতার একটা শিক্ষা গোপনে গোপনে হয়ে যেত।
বিশ্বকাপ এলেই সবার মাঝে একটা উন্মাদনা লক্ষ করতাম। খেলার মাঠে মাঝে মাঝেই এলাকার বড় ভাইয়েরা বসে আড্ডা দিতেন। সেখানে তাদের মাঝে আর্জেন্টিনা সমর্থক যেমন ছিলেন, তেমনি ব্রাজিল সমর্থকও ছিলেন। ফলে বিশ্বকাপে কোন দল ভালো কোন দল খারাপ তা নিয়ে বিতর্ক হতো তাদের মাঝে। সেসব বিতর্কে যুক্তি ছিল, জিজ্ঞাসা ছিল, আত্মসমালোচনা ছিল। তবে বর্তমানে ট্রল বলে যে জিনিসটা আছে তা তখনো আবিষ্কার হয়নি। বয়সে যারা বড় ছিলেন তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই ছোটরা তাদের জিজ্ঞাসা বা মতামত দিত। আমি তাদের সেই প্রাণবন্ত আড্ডার দর্শক হতাম মাঝেমধ্যে। ছোট ছিলাম বলে সেই আড্ডায় সক্রিয় না হলেও আমার জানার সীমার মধ্যে কোনো বিষয় চলে এলে প্রায়ই মতামত দিতাম। সেই জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় যারা অংশ নিত তারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা এবং বিনয়ী হওয়ার একটা শিক্ষা পেয়ে যেত।
সময়ের পরিক্রমায় সেই আড্ডার ধরনে বদল ঘটে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের দূরত্ব তৈরি হয়।
আসে ২০০৬ বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে যায়। নতুন প্রজন্মের ব্রাজিল সাপোর্টাররা মিছিল বের করে। ভাবছেন ব্রাজিলের সাথে খেলা ছিল? না, আর্জেন্টিনা জার্মানির কাছে টাইব্রেকারে হেরেছিল। আর এতেই আনন্দিত হয়ে ব্রাজিল সাপোর্টাররা মিছিল করেছিল। পরদিন ব্রাজিল ফ্রান্সের কাছে ১-০ গোলে হেরে বিদায় নেয়। ফলে আগের দিনের ব্রাজিল সমর্থকদের মিছিলের জবাব দেয় আর্জেন্টিনা সমর্থকগোষ্ঠী। তারা আরো বড় মিছিল করে।
এরপর আসে ২০১০ বিশ্বকাপ। সেই সাথে আসে আরো নতুন প্রযুক্তি। আধুনিক এই যুগে মানুষ আর এনালগ থাকে না। সবাই তার মনের রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, ভালোবাসা কাছের বন্ধু বা মানুষের কাছে আর বলে না। বলে ফেসবুকে। এখানে বড়দের সম্মান করার ঝামেলা নেই, বিনয়ী হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, নেই নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রাখার চিন্তা। ফলে আবিষ্কার ঘটে ট্রলের। সবাই নিজের ইচ্ছামতো ট্রল করে অন্যদের। বিশ্বকাপে এই ট্রল পায় নতুন মাত্রা। পছন্দের দলের সাথে যে দলের খেলা তাদের নিয়ে মানুষ যতটা না ট্রল করে, তার চেয়ে বেশি ট্রল করে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে আর ব্রাজিলকে নিয়ে। এই ট্রলে থাকে না কোনো যুক্তি, থাকে না কোনো জিজ্ঞাসা। এই বিশ্বকাপেও ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা একইসাথে ব্যর্থ হয়। তবে সমর্থকদের মুখের জোর কমে না। তারা আত্মসমালোচনা যতটা না করে তার চেয়ে একে অপরের পেছনে লেগে থাকে বেশি।
বর্তমানে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা সমর্থকদের কর্মকাণ্ড এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের আর সমর্থক বলে মনে হয় না। তারা এখন এন্টি ব্রাজিল আর এন্টি আর্জেন্টিনা সাপোর্টার। বিনয়, ব্যক্তিত্ব, শ্রদ্ধাবোধ বিসর্জন দিয়ে এখন সবাই একে অপরকে পচাতে পারলেই খুশি। প্রযুক্তি আমাদের আধুনিক করেছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সৌহার্দ্য।
লেখকঃ সহযোগী সম্পাদক
নিউজ বাংলা ২৪.কম.বিডি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here