রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪ তম জন্ম বার্ষিকী

কবিগুরুর জন্ম এবং মৃত্যু: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল মঙ্গলবার, ৭ মে ১৮৬১ ইংরেজি, সোমবার ২৫শে বৈশাখ (বাংলা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন হবার কারনে আজ ২৪  বৈশাখ) ১২৬৮ বঙ্গাব্দ ভোর রাত ২টা ৩০মিঃ থেকে ৩টার মধ্যে কলকাতার জোড়াসাঁকোস্থ ৬, দ্বারকানাথ ঠাকুর লাইনের তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ৭ আগস্ট ১৯৪১ ইংরেজি, ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে দুপুর ১২টার কিছু পরে কলকাতার জোড়াসাঁকোতেই তিনি ৮০ বছর ৩ মাস বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ২৫ জুলাই ১৯৪১ ইংরেজিতে তাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে চিকিৎসার সুবিধার্থে কলকাতাতে নিয়ে আসা হয় এবং এখানেই ৩০শে জুলাই তিনি তাঁর শেষ কবিতাটি বর্ণনা করেন।

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে তিন দিনের উৎসবকুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কবিগুরুর ১৫৮তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কবির স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার। আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থাকছে গ্রামীণ মেলার আয়োজন। উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।

জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, বিশ্বকবির জন্মজয়ন্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তিন দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। তবে রমজান থাকায় এবার অনুষ্ঠান সন্ধার আগেই শেষ করা হবে।

এদিকে নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আত্রাই উপজেলার নাগর নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসর কাছারিবাড়িতে বইছে সাজ সাজ রব। প্রতিবছরই এখানে বসে মানুষের মিলনমেলা। দূর-দূরান্ত থেকে কবির ভক্তরা ছুটে আসেন পতিসর কুঠিবাড়ি প্রাঙ্গণে। আজ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি।

মহামানবের সাগরতীরে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবির মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরী।

নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’

নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন, অগ্নি-বীণা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।’…

এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়।

১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি।

তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

১৯২২-এর ২৫ জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ স্মরণসভায় নজরুলকে ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন ‘সত্যকবি’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে নজরুলকে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ করায় তখনও কবি-সাহিত্যিকরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক পরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে কিন্তু দুই কবির শ্রদ্ধা ও স্নেহের মৌলিক সম্পর্ক কখনও বিচলিত হয়নি।
১৯২৩-এর ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো মামলার রায় দেন। এতে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়।

এই বছরই ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগারে থাকাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে বলেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’

এই বইটি নজরুলকে উৎসর্গ করায় রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক খুশি হতে পারেননি। তাই রবীন্দ্রনাথ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’

রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন ‘নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।’

পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’

নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।

১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে নজরুল অনশন করেন। এই অনশন ভঙ্গ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় নজরুল ইসলামের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে লেখেন, Give up hunger strike, our literature claims you. জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। কারণ, নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেবেন। কিন্তু অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও এভাবে নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।

নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে ‘নাগরিক’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। বেশ অসুস্থ। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, ‘…তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জিলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’
মানুষ, মানবতা নিয়ে দুজনের ভাবনায় কোনো প্রভেদ নেই। নেই ধর্মপরিচয়ের বাইরে মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখার।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। বলেন, মানবিক ধর্মের কথা যা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্ধ্বে। একইভাবে নজরুল বলেন, ‘আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি। মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। শ্রষ্টাকে আমি দেখিনি কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি। এই ধূলিমাখা, অসহায়, দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে।’

নজরুল লিখেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ সেই চিরায়ত উপলব্ধি-‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’

সাম্য, মৈত্রী, মানবপ্রেম তথা মানবিকতার প্রকাশে যেমন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে বাস্তবে অগ্রনায়ক, রাজনৈতিক বিষয়-সংলগ্ন হয়েও তেমনি নজরুল। রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধ বিরোধী, শান্তিবাদী, বিশ্বনাগরিক এবং মানবপ্রেমী। তার বহু রচনায় এমন প্রমাণ মেলে। নজরুলের মানবিক চেতনা সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে এক হয়েছে তৃণমূল স্তরের সাধারণ মানুষের কল্যাণে।

কাজী নজরুল ইসলাম গুরু বলে মান্য করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল নিজের কাব্য চর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, ‘তুমি নাকি এখন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছো?’ নজরুল উত্তরে লিখেছিলেন, ‘গুরু কন আমি নাকি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছি…।’

রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here