মুহম্মদ কাঞ্চনউল আজিজ

বরেণ্য গবেষক, সাহিত্যিক, বিদ্রোহী পণ্ডিত ও মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে গবেষণাধর্মী বহু সম্পাদিত গ্রন্থের প্রণেতা অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৯ সনের ২৪শে ফেব্রুয়ারি এই দেশবরণ্য ব্যক্তিত্ব ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। শিক্ষাজীবনে ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ১৯৬৭ সালে কবি সৈয়দ সুলতান ও তার যুগ এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনায় পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে কলেজে অধ্যাপনা (১৯৪৫-১৯৮৯) মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরে এক বছরেরও কিছু বেশি সময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সহকারী হিসাবে থাকার পর ১৯৫০ সনের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে যোগ দিয়ে একটানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৮৩ সনে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি বাঙলা বিভাগের চেয়ারম্যান সহ সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সভাপতি ও চার চার বার কলা অনুষদের ডীন নির্বচিত হন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের রূপকার ছিলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কবি কাজী নজরুল অধ্যাপক (১৯৮৪- ১৯৮৬) পর্যন্ত নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগৎ এর প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে ড: আহমদ শরীফই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি সকলের কাছে প্রিয় হবার দুর্বলতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁর চিন্তাধারায় ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মার্কসবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, বক্তব্য ও লেখনীতে তাঁর রচিত শতাধিক গ্রন্থে তিনি জোরালো যুক্তি দিয়ে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস , সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন এবং আন্তরিকভাবে আশা পোষণ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার। পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই এর শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকামীদের কাছে তাঁর রচিত পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষনীয় । তাঁর রচিত পুস্তক রাশির মধ্যে বিচিত্র চিন্তা, যুগযন্ত্রনা, কালিকভাবনা, স্বদেশ অন্বেষা, বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য (১ম ও ২য় খন্ড), বাঙলার সুফী সাহিত্য, মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপসহ শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগের বাঙালি সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়তুল্য গবেষণা কর্ম তাঁকে কিংবদন্তি পণ্ডিতে পরিণত করেছে। উভয় বঙ্গে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অদ্যাবধি এই স্থানটি শূন্য রয়ে গেছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেছেন তিনি মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনায়। বিশ্লেষণাত্নক তথ্য ও যুক্তি সমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃৃতির ইতিহাস বাঙ্গালা ভাষা-ভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন। তিনি জীবিতকালে এরই স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত হন।
উপমহাদেশের সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতি ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসামপ্রাদায়িক, যুক্তিবাদি, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধির ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ও ব্যক্তিত্ব ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণে ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করেছিল। কথা ও কর্মে অবিচল, অটল, দৃঢ়চেতা আহমদ শরীফ সবরকম প্রথাসংস্কার শৃঙ্খলা ছিন্ন করে ১৯৮৫ সনে অসিয়তনামার মাধ্যমে মরনোত্তর দেহ ও চক্ষু দান করে গেছেন। সেই অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল, চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ প্রতীক, কাজেই গোটা অঙ্গ কবরে কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাইতো বাঞ্চনীয়।
সর্বোপরি বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও বিদ্রোহী পণ্ডিত ড. আহমদ শরীফ ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৎ, উদার, ন্যায়পরায়ণ, জেদী, পরোপকারী ও ক্ষেত্র বিশেষে দানশীল ছিলেন। ইনি আমার বাবার অগ্রজ সহোদর হন। দূরারোগ্য ব্যাধিতে বাবার অকাল প্রয়াণের পর আমাদের অভিভাবকত্বের ভূমিকা পালন করতেন। সুদূর রাজধানী ঢাকা থেকেও সর্বক্ষণ আমাদের পরিবারের খোঁজ খবর নিতেন। জীবদ্দশায় যতবার বাড়িতে এসেছিলেন বিদায়কালে আমাদের সব ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরে অবোধ শিশুর মত কাঁদতেন। আমরা পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করলে উৎফুল্ল মনে প্রশংসাসূচক লম্বা চিঠি লিখতেন কিংবা ফোন করতেন, আর উৎসাহ যোগাতেন। বয়সের দোষে দুষ্টামি কিংবা ছোট খাট অপরাধ করলে, যদি শুনতে পেতেন চিঠি কিংবা ফোনে শাসন করতেন আর সু্‌উপদেশ দিতেন। উনি পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত স্থাবর সম্পত্তি আমাদেরকে (ভাইপোদের) দিয়ে গেছেন বিনা অর্থ-শর্তে। এদেশের ধর্মান্ধ, স্বার্থপর, সুবিধাবাদী ও চাটুকার প্রকৃতির শিক্ষিত জনের কাছে উনি যতই বিতর্কিত হোন না কেন, তিনি আমাদের পরিবার, স্বজন, শুভাকাঙ্খীদের কাছে শ্রদ্ধা-প্রিয়ভাজন ও দেবতুল্য একজন মানব। তাঁরই স্বরচিত ও সম্পাদিত মধ্যযুগের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা সাহিত্যকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাই সম্মানিত পাঠকবৃন্দকে অনুরোধ করব এই যে, স্রষ্টা জ্ঞানার্জনে কোনোরূপ বাধারোপ করেননি তাই ড. আহমদ শরীফ রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থাদি পাঠ করে জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করুন এবং তাকে জানুন-চিনুন। ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here