আবদুর রহমান মল্লিক: ঠিক ধূমকেতুর মতোই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ ঘটেছিল নজরুলের। বিশ্বকবির সোনারতরী যখন কানায় কানায় ভর্তি সেই মুহূর্তে নজরুল কী বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীকে চমকে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কোনোভাবেই আমাদের বিবেচনার বাইরে থাকে না। রুদ্র কালবোশেখির মতো দোর্দণ্ড প্রতাপে সবকিছু ছাপিয়ে নজরুল এক অনন্য বিশাল ধূমকেতু হয়ে সমগ্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে, এমনকি রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিলেন।
নজরুল-প্রতিভাকে তুলে ধরতে সাহিত্যের সমালোচকগণ যেন কিছুতেই পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। কীভাবে ব্যাখ্যা করলে নজরুলকে বোঝানো যাবে তা নিয়ে আজও চেষ্টার অবধি নেই। বাংলা সাহিত্যের নগণ্য ছাত্র হিসেবে এ যাবৎ নজরুলকে নিয়ে যা-ই লিখতে বসেছি আবেগে আপ্লুত হয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি। কারণ নজরুলের কতটুকু জানি যে তাকে তুলে ধরতে পারব? বারবার মনে হয়েছে অন্ধের হাতি দেখার মতো হবে নাতো? কবির জন্মবার্ষিকীতে এক শুভাকাঙ্ক্ষী দাবি করে বসলেন, কিছু একটা লিখতে। তবে একথা সত্য সেই ছোট্ট বেলা থেকেই কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে আসছি।
বিশ্বাস, জীবনবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যে নজরুল যতটুকু আমাদের, আর কেউ ততটুকু আমাদের হয়ে উঠতে পারেননি। কারণ বাঙালি মুসলমানের সংগ্রাম, স্বাধীনতা, বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও স্বপ্ন, সাংস্কৃতিক আত্মিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা নজরুল ছাড়া আর কেউই সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারেননি।বাংলাদেশের জাতিসত্তার এতটা কাছে এসে স্বজনের মতো নজরুল ছাড়া আর কেউ দাঁড়াতে পারেননি। শুধু তাই নয়, আর কেউ বাংলাদেশের জাতীয় কবির স্বীকৃতি দাবি বা প্রত্যাশাও করতে পারেননি।
বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত যে, এক অনন্য কবি প্রতিভা নজরুলকে আমরা জাতীয় কবি হিসেবে পেয়েছি। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাঁর জন্ম ছিল একটি নিদ্রিত জাতির মধ্যে মহাজাগরণের ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রবল উত্থানে প্রকম্পিত। নইলে কী করে একুশ-বাইশ বছর বয়সে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো কবিতা রচনা করে চেতনার অগ্নিমশাল জ্বালিয়েছিলেন? কী করে বলতে পারেন-
‘আমি নৃত্য পাগল-ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই-
আমি মুক্ত জীবনানন্দ।’
কবিত্ব শক্তিতে কতটা শক্তিমাণ হলে খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া তিনি ঊর্ধ্বলোকে গমন করতে পারেন? নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বিস্মিত হয়েছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘দুই কবি: দুই বিপরীত মেরুর প্রতিভূ’ প্রবন্ধে বলেছেন, প্রতিভার বিচারে নজরুল অনেক বেশি উজ্জ্বল। তাঁকে রীতিমতন প্রডিজি বলা যেতে পারে। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে বালক নজরুল লেটোর দলের জন্য গান ও পালা রচনা করতেন। অত কম বয়স, ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বিদ্যে, তাঁর গান ও পালার জন্য পয়সা পর্যন্ত পেতেন, এটা বিস্ময়কর নয়! প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের মক্তবে, মসজিদ সংলগ্ন পরিবারের সন্তান, তাঁদের ব্যবহারিক ভাষাকে বলা হত ‘মুসলমানি বাংলা’, তাতে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ ছিল স্বাভাবিক, তবু ওই অবস্থাতেই নজরুল বাংলা কবিতার ছন্দ-মিল আয়ত্ত করেছিলেন, এমন কি ইংরেজি শব্দও ইচ্ছে মতন ঢুকিয়েছিলেন।”
নজরুল একটি জাতিকে গড়ে তোলার মূলমন্ত্র দিয়ে গেছেন। একটি শিশুর জন্যও দরদ ভরা কণ্ঠে কবিতা লিখেছেন। ভেতরের সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাদের কচিমনের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। “থাকব নাক বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে”- কি অসাধারণ করে পুরো পৃথিবীটা একটি মানব শিশুর কাছে উন্মোচন করেছেন। নারী অধিকার নিয়ে যখন নানা কথার ফুলঝুরি তখনই তাঁর কণ্ঠে শুনেছি শ্বাশত বাণী- “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। শুধু তাই নয় বলেছেন, “নর যদি করে নারীরে বন্দি তবে এরপর যুগে/আপনারই রচা সেই কারাগারে পূরুষ মরিবে ভুগে। যুগের ধর্ম এই-পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই”। বাংলা সাহিত্যে দ্রোহের এমন উচ্চারণ কে কবে করেছে জানা নেই।
নজরুল যেমন তার অপরিসীম সাহসিকতা দিয়ে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতিকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তেমনি নরনারীর হৃদয়ঘটিত প্রেমের জয়গান করেছেন। নজরুল কারো বিরাগভাজন হবার ভয়ে সংকুচিত হয়ে কথা বলেননি। অবহেলিত অপাংক্তেয় খেটে খাওয়া মানুষের হয়ে কথা বলেছেন। ধর্মের নামে ভন্ডামীর বিরুদ্ধে তিনি যারপরনাই খড়গ হস্ত হয়েছেন। যে নজরুল গেয়েছেন ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’, সেই নজরুল উচ্চারণ করলেন, “কোথা চেঙ্গিস, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? /ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার”!
“আলগা করোগো খোঁপার বাঁধন”-এর মতো অসংখ্য প্রেমের গান রচনা করে নজরুল প্রেমের চিরন্তন অভিব্যক্তিকে উচ্চকিত করেছেন। কবির জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। এই প্রেমই তাঁর কবিতা এবং গানের অন্যতম প্রেরণাদাত্রী। আবার প্রেমে ব্যর্থ কবিহৃদয়ে বেজে উঠেছে বিরহের সুর। প্রেম আর বিরহের শত শত গান নজরুলকে দিয়েছে অনন্য গৌরব
“মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণতুর্য “। বিন্দুর মাঝে সিন্ধুকে উপলব্ধি করার মতো এই লাইনেই বোধহয় নজরুলকে আমরা চিনতে পারি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। নিজ ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাস থাকার পরেও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে এককাতারে শামিল করার চেষ্টা করেছেন। নিপীড়িত মানুষের আহাজারি নজরুলকে বেদনাহত করেছে।অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাই তিনি বিদ্রোহ করেছেন। হাসিমুখে কারাবরণ করেছেন।
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি লিখেছেন, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা। তাঁর কবিতা স্বৈরশাসকের মুখে চপেটাঘাত করেছিল বলেই তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। নজরুল কারারুদ্ধ হবার পর তাঁর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নির্লিপ্ত ছিলেন না। প্রিয় নজরুলকে উৎসর্গ করে ‘বসন্তকুমারী’ নাটক জেলখানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এককথায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে নজরুলকে কারামুক্ত করতে ব্রিটিশ বেনিয়া বাধ্য হয়েছিল।
হুগলি জেল সুপার মি. আর্সটেন কয়েদিদের নিপীড়নের বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতেন যেন তারা সরকারের প্রতি অবনত হয়। কিন্তু যখন কয়েদিগণ নজরুলের নেতৃত্বে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, আর্সটেন তখন তাদের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করেন। তখন নজরুল কয়েদিদের নিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ধর্মঘটের ৩৮ তম দিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের নিকট একটি চিরকুট পাঠান, যেখানে বলা হয়েছিল- “Our Poetry Claims you”. চিরকুট পেয়ে অনশন ভেঙেছিলেন।।
সমাজ সংসার বিবাগী হয়ে নিজেকে জাহির কিংবা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে নজরুল গান কবিতা কিছুই করেননি। নজরুল ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতায় সমুজ্জ্বল। নাগরিক চেতনা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আমৃত্যু লড়াই করেছেন।
ঈদের বাঁকা চাঁদ যখন পশ্চিমাকাশে হেসে ওঠে তখন আকাশ বাতাস মুখরিত করে নজরুলের গান- “ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। মনে হয়না এই গানের বিকল্প কোনো গান কোনোদিন রচিত হবে। সৃষ্টিকর্তা যেন নজরুলের ভেতর এক বিস্ময়কর কবিত্বপ্রতিভা ফুঁকে দিয়েছিলেন। আর একারণেই নজরুলের এত এত কবিতা গান জগৎ-বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। মনের অজান্তেই তাঁর গান মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়।
নজরুলকে ভালো না বেসে কোনো জো নেই। নজরুল তাঁর ভেতরের প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে মানুষের ভালোবাসাকে আদায় করে নিয়েছেন। নজরুল জানতেন, তিনি কী সৃষ্টি করে যাচ্ছেন।তাই বলেছেন- “আমায় নহে গো, ভালোবাসো শুধু, ভালোবাসো মোর গান।”
জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যদিয়ে একজন দুখু মিয়া কী করে নজরুল হয়ে উঠলেন সেটিও আমাদের বুদ্ধির অগম্য। বিভিন্ন ধর্ম ও বিভিন্ন ভাষার ওপর নজরুলের পাণ্ডিত্য রীতিমতো বিস্ময়ের। দেশি বিদেশি বিভিন্ন শব্দের সার্থক প্রয়োগ আমাদের চমকিত করে। তার গানে শব্দ ও সুরের ঝঙ্কার আমাদের সাড়া জাগায় আমাদের বোধি ও মননে। জাতির সত্যিকার জাগরণে নজরুল চর্চা আমাদের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য।