আবদুর রহমান মল্লিক:
বইয়ের আগ্রহী পাঠকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বই মেলার স্টলগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে কয়েকটি প্রকাশনীর স্টলে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পাঠকের উপস্থিতি। এসব মনোযোগী পাঠকের তাদের পছন্দের বই কেনার ক্ষেত্রে যেন কোনো কার্পণ্য নেই। ক্রেতা সমাগম ও মেলায় এবারে সর্বাধিক আলোচিত প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে রয়েছে কথাপ্রকাশ, পাঞ্জেরী ও প্রথমা। দেখা গেছে মানের দিক থেকে অনন্য বই গুলোই পাঠক সংগ্রহ করছেন।
দিনের পর দিন বই মেলা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে । বিপুল সংখ্যক পাঠক ও দর্শনার্থী সমাগমের কারণে ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির বই মেলা সোওরাওয়ার্দি উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়। জানা গেছে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। এই বই ছিলো বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। সেই থেকে চলছে প্রতিবছর বই মেলার আয়োজন।
প্রকাশনার সাথে যুক্ত বিভিন্ন কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, গত ২১,২২ ও ২৩ ফেব্রæয়ারি সরকারি ছুটির দিন থাকায় তারা সর্বোচ্চ বিক্রির টার্গেট করেছিলেন। কিন্তু লম্বা ছুটি পাওয়ায় অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। তাই এ সময় বিক্রিটা আশানুরূপ হয়নি। নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৮ এ বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত কথাপ্রকাশে গিয়ে দেখা গেল ক্রেতা ও পাঠকের ভীড়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাকিরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, প্রবন্ধগ্রন্থ সিরাজুল আলম খানের গণতন্ত্রের অভিমুখে,যতীন সরকারের প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা, গল্প-উপন্যাস- সেলিনা হোসেনের ‘সময়ের বিষপিঁপড়া’, সুমন্ত আসলামের ‘এক মায়াবতী আমার’ কিশোর গোয়েন্দা মোশতাক আহমেদের ‘খুলি বাবা’ ও ‘কানা দস্যু’ তাদের প্রকাশিত এবারের সর্বাধিক বিক্রিত বই ।
পাঠ্যপুস্তক সহায়ক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন সমধিক পরিচিত। তবে তাদের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। সুদৃশ্য প্যাভিলিয়নে বিক্রয়কর্মীদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ক্রেতা সমাগম ছিল প্রচুর। বিতরণ-প্লানিং বিভাগের কর্মকর্তা আব্বাস উদ্দিন সবুজ জানান, তাদের সর্বাধিক বিক্রিত কমিকসের বই-‘বেসিক আলী’ সহ বিভিন্ন কিশোর কমিকস। বই প্রকাশনা জগতে গুরুত্বপূর্ণ জায়াগা দখল করে আছে প্রথমা প্রকাশন। প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি ম্যানেজার জাকির হোসেন জানান তাদের বিক্রি মোটামুটি সন্তোষজনক। সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘এক-এগারো: বাংলাদেশের রাজনীতি ২০০৭-২০০৮’ আনিসুল হকের ‘এই পথে আলো জে¦লে’ শাহদুজ্জামানের ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ মাসরুর আরেফিনের আবছায়া’ স্টিফেন হকিংয়ের(অনুবাদ) ‘বড় প্রশ্ন ছোট উত্তর’ বইগুলোর কাটতি অনেক ভালো। ঐতিহ্যে আল মাহমুদের বইসহ সুহান রিজওয়ানার ‘পদতলে চমকায় মাটি’ বই অধিক বিক্রি হয়েছে। সাবিদিন ইব্রাহীমের ‘জীবন গড়তে চাই’ মিমি হাইসনের ‘রক্ততৃষ্ণা’ আমজাদ হোসেন কাজলের ‘সাক্ষী ছিলেন শিরস্ত্রাণ’ শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইগুলোর বেশ বিক্রি হয়েছে বলে জানান, স্টলের ক্যাশ ইনচার্জ রাসেল আহমেদ।
পাঠক সমাবেশের নতুন প্রকাশিত বই ‘আমার হারানো আমি’ অধিক বিক্রির তালিকায়। এটি আত্মশক্তির অন্বেষণ ও সংকট উত্তরণ বিষয়ক। এছাড়া রয়েছে আরজ আলী রচনাসমগ্র, জাহিদুল জহিরের গল্প ও উপন্যাস,‘ভাসানীর ভারত প্রবাস’, শিশুদের ‘শিকারী ঈগল ও অন্যান্য’। বই প্রকাশনার পুরোনো প্রতিষ্ঠান মাওলা ব্রাদার্স বেচা-বিক্রিও উল্লেখ করার মতো। ‘সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃদকম্পের টানে’ গাজী মোজাম্মেল হকের নিষ্কন্টক জমির মালিকানা’ শাহদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’, ‘রুদ্রসমগ্র’সহ কয়েকটি বই তাদের ভালো বিক্রি হয়েছে। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের কর্মকর্তা কাউসার আহমেদ জানান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’সহ তাদের বেশ কয়েকটি বই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
গুনী লেখকদের কেউ কেউ মেলায় তাদের প্রকাশক প্রতিষ্ঠানের স্টলে উপস্থিত থেকে পাঠক-দর্শকদের সাথে মতবিনিময় করেন। পাঠক ও ভক্তদের অনুরোধে বইয়ে অটোগ্রাফও এঁকে দেন। লেখক পাঠকদের এই আত্মিক সংযোগও মেলার উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট সকলেই। চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নীকান্ড ও নিহতের ঘটনা মেলায় অনেকখানি প্রভাব ফেলে । তবে শেষদিকের দিলেগুলোতে মেলা বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে।