ফাতেমা ইরাজ

সকাল আটটা হবে হয়তো। মিনু পাশের বাড়ি থেকে ঝুড়িতে করে গোবর এনে  উঠনের কোনে বসে ঘুটে দিচ্ছিল। মেয়ে শিউলি বারান্দায় বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে,ঐ দেখা যায় তাল গাছ,ঐ আমাদের গা…শিউলি পড়তে পড়তে বইয়ের দিকে তাকিয়েই মাকে বলল “মা গরে কি মুড়ি আছে?তাইলে আমারে দুইডা দাও খুব খিদা লাগছে।” শিউলি কোনো উত্তর না পেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মিনু ঘুটে হাতে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে,চোখ দিয়ে টপটপ কর পানি পরছে।শিউলি আর কিছুই বলল না।সে বুঝতে পারলো মায়ের মন ভালো নেই।যদিও এটা শিউলির বোঝার বয়স না,কিন্তু পরিবেশ তার বয়স যেন দশ গুন বাড়িয়ে দিয়েছে।

শিউলি বোঝার পর থেকেই দেখছে তার বাবা রমিজ প্রায়ই বাজার করে না,না বলে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়।এক সপ্তাহ, পনের দিন,একমাস পরে আসে।এবার তো আড়াই মাস হলো রমিজ বাড়ি আসেনি।মিনু বাজার আনতে বলেছিল তখন মিনুর কাছে শিউলির কানের দুল জোড়া চায়।বলে বন্ধক রেখে বাজার করবে পরে আবার টাকা হলে ছাড়িয়ে আনবে।এমন বলে এর আগেও রমিজ মিনুর গয়না নিয়েছে আর ফেরত আসেনি সেগুলো।তাই এবার মিনু  শিউলির গয়না দিতে রাজি হয় না।কারন একেতো রমিজ গয়না নিলে আর ফেরত আসে না।তার উপর মিনুর মা দু বছর হলো মারা গেছে।এটা তার শেষ স্মৃতিচিহ্ন।মারা যাবার আগে শিউলিকে দিয়েছিল।তাছাড়া শিউলি তো মেয়ে ওরতো বিয়ে দিতে হবে একটু গয়না তো দিতেই হবে।রমিজের যে অবস্থা তাতে সে তো আর বানিয়ে দিতে পারবেন।গয়না নিয়ে রমিজ আর মিনুর মধ্যে ঝগড়া হয়।রমিজ মিনুকে মারধর করে দুল জোড়া নিয়ে যে বের হয়ে যায়।আজ প্রায় আড়াই মাস,আর কোনো খোঁজ নেই।

বিকেলে শিউলি উঠানে খেলছিল।মিনু ঘুটে বিক্রি করে দুই দিন পর আজ বাজার করে এনেছে।এক কেজি চাল,এক পোয়া ডাল,পাঁচ টাকার তেল আর এক পোয়া পোলাউয়ের চাল।যদিও দোকানে কিছু টাকা বাকি আছে।মেয়েটা সেদিন জ্বরের মধ্যে পোলাউ এর কথা বলল তাই বাকিতেই এনেছে।কত দিন আর ঐটুকু মেয়ে কচু ঘেচু খেয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া দুদিন তো চুলায় হাড়িই বসে নাই।তাও যদি মেম্বারের বউ ডেকে চিড়া না দিতো মেয়েটা কে নিয়ে হয়তো না খেয়েই থাকতে হতো।একবাটি পান্তা ভাত ও দিয়েছিল।অনেক দিন পর আজ পোলাউ রাধবে তাই মিনুর মন খুব খুশি।তাই সে তারাতারি রান্না করতে গেল।তাছাড়া রাত হয়ে গেলে রান্না করতে বাতিও তো লাগবে।সব ভেবে আগেই রান্না বসালো।মিনুর একটা মুরগি আছে।মুরগিটা আজ ডিম ও পেরেছিলো।মিনু মনে মনে ভগ্যটাকে গালি দিলো তার হাতে নাকি মুরগী হয়না এজন্য। হলে তো আজ দুটো ডিম দুজনে খেতে পারতো। মিনু ডিমটাকে সিদ্ধ করে দুভাগ করে খুব ভালো করে রান্না করেছে।রাধতে রাধতে সে ভাবছিল মেয়েটা কত আনন্দ করেই না আজ ডিম দিয়ে পোলাউ খাবে।সে নিজেও কত দিন খায়না।মাঝে মাঝে এর ওর বাড়ি থেকে যে খাবার দেয় তাতে মেয়েটারই আধপেটা হয়।নিজের আর খাওয়া হয়ে ওঠেনা।আর বেশির ভাগ সময়ই তো দেয় পান্তা, পঁচা,বাশি দেখা গেছে একটা লোভনীয় খাবার কেউ দিল।বাড়ি এনে মা মেয়ে খেতে বসে দেখে নষ্ট হয়ে গেছে।তখন মায়ের মন কেমন ছটফট করে।শিউলি উল্টো মাকে শান্তনা দেয়।”আমার এসব খাইতে মন চায় না”বা বলে পেটে ব্যথা।”ইত্যাদি।রান্না করতে করতে মিনু অনেক কিছু ভাবতে লাগলো রমিজ কত ঝামেলা করেই না মিনুকে বিয়ে করেছিল।মিনুর বাবা মা কেউ তো বিয়ে দেবেই না রমিজের সাথে।ওর আর্থিক অবস্থা ভালো না।অবশেষে মিনুর মাকে রাজি করে বিয়ে করলো।বিয়ের সময় কত গয়না গাটি দিয়েছিল কিছুই নেই।সব রমিজ বিক্রি করে দিয়েছে।এমন কি বাবার বাড়ি মিনুর ভাগের সম্পত্তিটুকুও বিক্রি করিয়েছে মিনুকে দিয়ে।মিনু এখন গিয়ে কোন মুখে দাঁড়াবে কোনো সাহায্য চাইতে।মা বাবাও নেই।আছে এক বড় ভাই।সে তো পরিচয় না দিতে পারলেই বাঁচে।তাই মিনু কষ্ট করে থাকে ভাইয়ের কাছেও যায় না।যদিও তার প্রচুর বিত্ত আছে।তাছাড়া মিনুকে সে দামেও ঠকিয়েছে।সামান্য কটা টাকা দিয়ে মিনুর সব সম্পদ লিখিয়ে নিয়েছে।

শিউলিদের বাড়িটা নদীর একদম পাশে।ঘর থেকেই নদী দেখা যায়।সন্ধ্যা হবো হবো এমন সময় খেলতে খেলতে শিউলি খেয়াল করলো ঘাটের দিকে একটা নৌকা আসছে।শিউলি দৌড়ে গিয়ে ঘাটের কাছে দাড়ালো।দেখলো রমিজ নৌকার মাথায় দাঁড়ানো।ধবধবে শাদা একটা পাজ্ঞাবী পড়া।শিউলি ঘাট থেকেই ডাকলো “মা বাপজান আইছে জলদি আও”।মিনু বিরক্তের সাথে বলল “তুইতো খোয়াবেও দেহো তর বাপজান আইছে।জালা দিস না,হাত পা ধুইয়া গরে আয়।পোলাউ রানছি।”শিউলি ফের বলল “মা সত্য সত্যই বাপজান আইছে।নতুন জামা গায়।”অনিচ্ছা সত্যেও মেয়ের কথায় সে ঘাটের দিকে গেল।নৌকা তখন ঘাট থেকে হাত পঁচিশেক দূরে,সন্ধ্যা তখনও নামেনি তাই স্পস্টই দেখা যাচ্ছিলো।শিউলির চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছিল।কিন্তু মিনারার মনে খটকা লাগছিল খানিকটা।একটা ছুইওলা নৌকা তাতে আবার পর্দা লাগানো।নৌকার মাথায় শাদা পাঞ্জাবী পরে দাড়িয়ে আছে রমিজ।নৌকা ধীরে ধীরে ককাছে আসছে।মিনুর বুক ধরফর করছে।তাহলে কি গ্রামের লোকজন যা বলছিল তাই হয়েছে রমিজ বিয়ে করেছে?রমিজের মুখ হাসি হাসি,এ হাসির ধরন যে মিনুর মোটেই ভালো লাগছে না মনে হচ্ছে  খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

নৌকা এসে ঘাটে ভিড়লো। নৌকার পাটাতনে একটা ছাগল ভ্যা ভ্যা কর ডাকছিল।পা বাধা দুটো মুরগিও কক কক করে ডাকছিল।

২.

পাশে একটা বড় কটকটে লাল রংয়ের একটা ট্রাংক,একটা গামছায়  বাধা একটা গামলা ও একটা থালা।সম্ভবত খাবার এনছিল পথে।

রমিজ হাক ছেড়ে শিউলিকে বলে”কিরে বেটি ক্যামন আছো?নে মুরগা দুইডা ধর”শিউলি হাত বাড়িয়ে মুরগি দুটা নিলো।রমিজ পর্দা ফাকা কর বলল” কিরে বউ লাজ পাও নাকি?বাইরে আহো বাড়ি আইসা পরছি।”পর্দার আড়াল থেকে রমিজের ছোট বউ বের হয়ে আসলো।মিনুর আর দাড়িয়ে থাকতে পারছিলো না তার মাথা ঝিম ঝিম করছে পা কাঁপছে।সে বসে পরল মাটিতে।ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার যেন মিনুকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

রমিজ নতুন বউয়ের হাত ধরে নৌকা থেকে নামাচ্ছে আর বলছে “দেইখো খেজুর গাছের ঘাট,  পা পিছলাইয়া পইরা যাইওনা।”এবং মাঝিকে বলল “ছাগল আর ট্রাংক তুলে দিস”। মিনু ওভাবেই বসে রইলো।রমিজ তাকে আদেশের সুরে বলল “গরে যাও নতুন বউরে বরন করা লাগে ভুইলা গেছ?”সেখানে মাটিতেই শিউলিকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো কিংকর্তব্যবিমূঢ় মিনু।কিছুক্ষণ পর রমিজ হাক ছেড়ে শিউলিকে ডেকে বলল “কিরে শিউলি তোর মা কিছু রানদে নাই?নতুন বউরে কিছু খাইতে দেওন লাগে বোঝে না?মেলা দূর দিয়া আইছি।”মিনু চুপ করে বসেই রইলো।খানিক বাদে রমিজ এসে মিনুকে লাথি ঘুষি মারতে মারতে ঘরে নিয়ে গেলো।শিউলি দৌড়ে গিয়ে রান্না ঘর থেকে পোলাউ আর ডিম এনে থালায় বেরে দিলো।তখন শিউলির চোখ পরল নতুন বউয়ের কানে তার দুল।কিছুই বলল না শিউলি। সে বাবা আর তার নতুন বউকে খাবার দিয়ে ফের মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।গোটা ঘটনায় শিউলি কি বুঝলো এখনি বলা যাচ্ছে না।

শিউলিকে নিয়ে ঘাটেই রাত পার করে দিলো মিনু।সকালে মিনু শিউলি কে নিয়ে ভাইয়ের বাড়ি যায়।শিউলির মামি রাবু খুব ভালো মানুষ।সে মিনুকে দেখে বুঝতে পরে রমিজ ওকে মেরেছে।মিনুর গালে তখনও রক্ত লেগেছিলো।কপালও কাটা।চোখে রক্ত জমে গেছে।সে সোজা হয়ে হাটতেও পারছিলো না।রাবু মিনুকে ধরে ঘরে উঠায়।মিনুর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল।মিনুর জ্বরটা রাতেই এসেছিলো।রাবু তার স্বামী মতিনকে খবর দেয়।মতিন এসে খুবই বিরক্ত হয়।রাবু মিনুকে ডাক্তারের কাছে নিতে বললে মতিন রাবুকে খুব গালাগালি করে।আর বলে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।তবে রাবু হাত পায়ে ধরে রাতটা রাখার জন্য অনুরোধ করে।তার ইচছা ছিলো মিনুকে তার ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেবে,সে মিনুকে কোনো কাজ জুটিয়ে দেবে।রাতে মিনুর জ্বর বাড়ে।রাবু কাছে যেতে চাইলেও মতিন যেতে দেয় না। মতিন মিনুকে রাতে বারান্দায় ঘুমাতে দেয়।তবে শিউলিকে বলে কাজের মেয়ে কইতরির কছে গিয়ে ঘুমাতে।

সকাল বেলা শিউলি গিয়ে দেখে মা মিনু মারা গেছে।

দুদিন মতিন চুপ থাকলেও এবার শিউলিকে তাড়ানোর জন্য উঠে পরে লাগেছে।কারন মতিনের মায়ের বেশ কিছুটা নিজস্ব জমি ছিলো তা তিনি শিউলির নামে লিখে দিয়েছিলেন।মতিনের সেটা চাই।মতিন আগে অবশ্য জানতো না।মিনু যেদিন মতিনদের বাড়িতে আসে সেদিন রাতে কইতরি মতিনকে গোপনে ঢেকে সে কথা জানায়।মিনু আসার পরে রাবুর সাথে বাড়ির সব ঘটনা যখন বলছিলো এ ও বলছিলো যে রমিজ শিউলির কানের দুল নতুন বউকে পরিয়েছে।মানুষ কতটা নিচ হলে মেয়ের গয়না নিকার বউরে পরায়।তখন কথায় কথায় সে জমির কথা ওঠে।কইতরি লুকিয়ে ওদের সব কথা শুনে নিয়ে ছিলো।সে পুরোটা মতিন কে জানায়।মতিন ভাবে রাবি যা সরল তাতে সে শিউলিকে সব জানিয়ে দেবে।তার চেয়ে ওকে তাড়ানো ভালো।মতিনদের কোনো সন্তান নাই।তাই রাবু চায় শিউলিকে কাছে রাখতে।অনেক জামেলা হাতে ধরধরি,পায়ে পরাপরির পর মতিন শিউলিকে রাখতে রাজি হয় তবে সর্ত দেয় যে রাবু কোনো দিন শিউলিকে বলতে পারবে না যে শিউলির জমি আছে আর ও কইতরির সাথে কাজবাজ করবে।রাবু তাতেই রাজি হয় তবু মেয়েটা কাছে তো থাকবে।তার পর সে তো আছেই,মতিন তো সারাদিন বাসায় থাকেনা রাতে আর কতটা কি দেখবে।রাবু প্রথম দিকে শিউলিকে স্কুলে পাঠাতো,কাজ করতে দিতো না।কিন্তু তাতে দিন দিন শিউলির উপর মতিনের অত্যাচার বেড়ে যায়।যদিও সব করতো মতিনের চোখের আড়ালে কিন্তু কইতরি মতিন ফেরার পর  যখন মতিনের পগা হাত-পা টিপতো,মাথার চুলটানতো তখন সব বলতো।খানিকটা বাড়িয়েও বলতো।তাছাড়া কইতরি যখন মতিনের কাছে ঘরে থাকতো তখন তার ঘরে সবার প্রবেশ নিষেধ ছিলো এমন কি রাবুর ও।কইতরিকে রাবুই তার বাবার এলাকা থেকে কাজে এনেছিলো।তখন ওর বয়স ছিলো নয় কি দশ।প্রথম দুই বছর ভালোই চলছিলো।তার পরই শুরু হয় নোংরামি।প্রথম যেদিন মতিনের চেহারা ধরা পরে সেদিন ছিলো কুরবানির ঈদ।মতিনরা একটা গরু কোরবানি করে তাই খুব দৌড়াদৌড়ি হুড়োহুড়ি,কাজের চাপ কিন্তু কইতরিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।রাবু ভাবলো হয়তো কাজের চাপে শরীর খারাপ লাগছে তাই কোথাও শুয়ে আছে।খুঁজতে খুঁজতে দোতলার ঘরে গিয়ে দেখে অর্ধনগ্ন কইতরি জড়িয়ে আছে মতিনকে।সে যেতেই দুজন ধরফর করে উঠে বসলো।রাবু তিনদিন কাঁদলো।তখন মতিনের মা বেঁচেছিল।তিনদিন পর রাবু শাশুড়িকে জানালো।মতিনের মা কঠোর শাস্তিও দিয়ে ছিলো মতিনকে।কইতরিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।কিন্তু তিন দিন পর মতিন নিজে গিয়ে কইতরিকে নিয়ে আসে।মতিনের মা সেই থেকে ছেলের ছোয়া পানিও সে গ্রহন করে না।এমনকি মৃত্যুর সময়ও মতিন মুখে পানি দিতে গিয়ে দেখে নিশ্বাস চলছে না।এটা হয়তো সৃষ্টিকর্তারই একটা খেলা।

৩.

দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেলো। শিউলি বেশ বড় হয়েছে। দেখতেও খুব সুন্দর হয়েছে।খুব মিশুক স্বভাবের হয়েছে।খুব হাসি খুশি থাকে সারাদিন।সন্ধ্যা নামলেই,আধার ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নেয়।চুপষে যায় সে মামা মতিনের ভয়ে।

রাতে প্রায়ই মাকে মন করে কাঁদে।তার চোখের সামনে ভেষে ওঠে মাকে করা বাবার সেই অত্যাচার,তাদের অভাব,বাবার বিয়ে ইত্যাদি।তার পর তো রয়েছেই মামার প্রতিদিন মামির উপর অত্যাচার। তাছাড়া মতিন প্রায় গভীর রাতেই কইতরিকে ডেকে নিয়ে যায় পাশের ঘরে।ঘন্টা খানিক বাদে সে গোসল করে ফিরে আসে।ছিহ্ কি লজ্জা!তবে কইতরিও তো এক হিসেবে নির্যাতিত ।কিন্তু কেন?এ সব কিছুই শিউলিকে খুব ভাবায়।কেন  পুরুষমানুষ গুলো এতটা বিবেকহীন হয়?কেন মেয়েদের জীবন এতটা অসহায়?কেন সব সময় মেয়েরাই নির্যাতিত?উত্তর খুঁজতে থাকে কিশোরী শিউলি কিন্তু কোনো উত্তরই খুঁজে পায় না সে।এসব যেদিন ভাবে কোনো কিছু ভালো লাগে না ওর।সারা রাত আর ঘুম হয় না ওর।

ইদানিং মতিন বেশ ভালো ব্যবহার করে শিউলির সাথে।প্রায়ই রাতে এসে খোঁজ খবর নেয় আমার কখনো পাশে বসিয়ে আদর করে।রাবু বেশ খুশি আজকাল।হয়তো মতিন পাল্টাতে শুরু করেছে।

একদিন দুপুরে মতিন বাড়ি এসে গেসল সেরে না খেয়েই সুয়ে পরে।বলে বাইরে খেয়ে এসেছে।রাবুর হঠাৎ খুব মন খারাপ লাগছে কেন জানি শাশুড়ির কথা মনে পরছে।কত ভালো ছিলেন তিনি।মেয়ের মত দেখতেন রাবুকে।মতিনের স্বভাব চরিত্রের অবস্থা দেখে বউয়ের ভবিষৎ ভেবে কিছু জমি আলাদা করে বউকে লিখে দিয়েছিলেন।সব চেয়ে বড় কথা হলো তিনি মতিনের অশ্লিলতার তিব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মতিনের কিছু সে গ্রহণ করে নি।মতিন না শোধরালেও রাবুর কোনো অভিযোগ করার জায়গা দেয়নি তিনি।রাবুর মা নৌকা ডুবিতে মারা যায় তার লাশটাও পাওয়া যায়নি।শাশুড়িকে পেয়ে সে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিল রাবু।মিনুকে আর রাবুকে কখনোই সে আলাদা করে দেখতো না।কজন শাশুড়ি এমনটা পারে?সবাই চায় বউ মেয়ের মত হবে,কিন্তু নিজেকে যে মায়ের মত হতে হবে তা একবারও ভাবে না।এইযে শিউলিকে যে সে এত ভালোবাসে তার জন্ম হয়তো শাশুড়ির কাছে ঋনের থেকেই।।শাশুড়ির কথা ভাবতে ভাবতে রাবু পুকুর পাড়ে কবরে পাশে গিয়ে বসে।তার মন খারাব হলেই সে এখানে আসে।

শিউলি গোসল করে কাপড় পাল্টাতে গোসলখানায় ঢোকে।সিটকিনি লাগাতে গিয়ে দেখে সিটকিনি ভাঙা।সে তরিঘরি করে কাপড় পাল্টাতে লাগলো এমন সময় মতিন এসে গোসলখানায় ঢুকে পরে।শিউলি চিৎকার দিলে মতিন মুখ চেপে ধরে বলল “চুপকর”।রাবু শিউলির চিৎকার শুনে কি হয়েছে বলতে বলতে দৌড়ে আসে কবরের কাছ থেকে।রাবুর গলা শুনে,মতিন গোসলখানা থেকে ছিটকে বেড়িয়ে নিজেই এসে বলে সে বুঝতে পারেনি ওখানে শিউলি আছে।ওর গামছাটা খুঁজে পাচ্ছিল না তাই খুঁজতে এসেছে।কথা শেষ হতে না হতেই সে চলে যায়।রাবুর প্রথম সন্দেহ হলেও আবার মনে মনে বলে! “না না সে ভুল ভাবছে শিউলি তো ওর নিজের ভাগ্নী,ও এমনটা নিশ্চই করবে না।মানুষ এতটা নিচে নামতে পারে না।এসব কি ভাবছে সে এতো পাপ।”শিউলি গোসলখানা থেকে বের হয়ে সোজা ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলো।কিছু খেলোও না দুপুরে।রাতেও উঠলো না সে।শুধু ভাবছে” মামা কি এটা ইচ্ছা করে করেছে?”আবার “ভাবছে না না এ হতে পারে না।কিন্তু মামা কেন তার মুখ চেপে ধরে বলল চুপ!”শিউলির আবার মায়ের কথা মনে পরছে।মনে পরছে বাবা অত্যাচারের কথা।আবার শিউলি খুজতে লাগলো তার প্রশ্নের উত্তর।কেন মেয়েরা অসহায়? শিউলির মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো সে আর ভাবতে পারছে না।তার প্রচন্ড জ্বর এসেছে।মন হচ্ছে মা তার মাথার কাছে বসে আছে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

এর কয়েক দিন পর কইতরির বাবার অসুখের কথা শুনে বাড়ি যায় বাবাকে দেখতে।দুপুর বেলা রাবু দোতলার ঘরে বসে নামায পড়ছিলো।হঠাৎ সে শিউলি চিৎকার শুনতে পায়।কোনো মতে সালাম ফিরিয়ে দৌড়ে নিচে এসে দেখে।মতিন শিউলির সাথে বিছানা ধস্তাধস্তি করছে রাবু দৌড়ো যেতে যেতে শিউলি মতিনের কপালে হাতের কাছে পাওয়া একটা টর্চ লাইট দিয়ে সজোরে আঘাত করে।মতিন মাথা চেপে ধরে।পাশেই সুয়ে পরে।

রাবু সন্ধ্যা তার ভাইকে খরব দিয়ে শিউলিকে একটা শিশু সদনে পাঠায়।শিউলির খুব মামির কথা মনে পরতো,মনে পরতো মামির সবাইকে লুকিয়ে আদর করা,লুকিয়ে খাবার দেয়া,লুকিয়ে পড়ানো,বই গুলো কত কষ্টেই না লুকিয়ে রাখা।এমন কি পরীক্ষার সময় কইতরিকে ছুটি দিয়ে বাড়ি ফাকা রাখা জাতে করে পরীক্ষা দিতে যেতে বাধা না আসে।সে কটা দিন কতই না কষ্ট করতো সে।বাড়ির সব কাজ সে একাই করতো শিউলিকে ছুতেও দিতো না।শিউলি দির্ঘ্য নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বলতে লাগলো সৃষ্টিকর্তার এ কোন খেলা ফেরেসতার মত এই মানুষটার কোলটা তিনি কেন খালি রাখলেন?

আর কেনই বা তার মত একটা মানুষের মামার মত মানুষের সাথে বিয়ে হলো?আর সমাজে মেয়েদের কেনইবা স্বাধীনতা নাই।মামি কেন পারলো না সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে।কেন মেয়েরা অসহায়? কেন মাকে এভাবে মরতে হলো।কেন শিউলি নিজে এত কষ্ট পাচ্ছে?কেন সে হাজার বার চাইলেও মামিকে কাছে পায় না?শিউলির আবার মাথা ঘুরতে লাগলো।জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে।

আজ মন্ত্রী  শেখর রায় সদনে আসবে।তাই গত তিন দিন ধরেই চলছিলো খুব ব্যস্ততা।

অবশেষে মন্ত্রীর আগমন। বেশ উৎব চলছে।সদনে শিশুরা নানা রকম ভাবে তাদের প্রতিভা তুলে ধরার চেস্টা করছে। কেউ গান,কেউ আবৃত্তি,কেউ ছড়া,কেউবা  আবার নাচ- অভিনয়।

বিকেলে একটা গাড়িতে করে কয়েকটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা ঘরে।শিউলি দেখলো তাদের কারোরই সদন নাম রেজিস্টারড ছিলো না। কিছুক্ষণ বাদে মন্ত্রী এলো সব মেয়েগুলোকে ঘুরে ঘুরে খুব বাজে নজরে দেখতে লাগলো,সব মেয়েগুলো ভয়ে কুকরে যাচ্ছিল।খানিক বাদে মন্ত্রী শিউলির দিকে তাকিয়ে তার লোকদের কে ইশারা করে চলে গেলো।

কিছুসময় পর একটা মেয়ে এসে শিউলিকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা নীল রং এর শাড়ী দিয়ে বলল নেও পড়ে নাও।শিউলি বলল “পারিনা”।মেয়েটা শিউলিকে শাড়ি পড়াতে পড়াতে ব্যঙ্গ করে বলল “ও আমিতো ভুলেই গেছি যে আমি কার সাথে কথা বলছি।সনদের মেয়ে আবার শাড়ি কই পাবে?যাই হোক এই মেয়ে শোনো স্যারের সাথে বেয়াদবি করো না কিন্তু।তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মানবে কিন্তু।”মেয়েটা থামতেই শিউলি বলল “আচ্ছা তোমাদের  স্যার সদনের মেয়েদের ছোয় নাকি?এত বড় মাপের মানুষ তিনি ঘৃনা লাগে না এসব ছুতে।”মেয়েটা কিছু বলল না শুধু একবার কর্কট দৃস্টিতে তাকালো।মেয়েটা মনে হয় রেগে গেছে।শিউলির এত কষ্টের মধ্যও কেমন জানি আনন্দ হচ্ছে  মেয়েটাকে রাগাতে পেরে।

শিউলিকে মেয়েটা খুব সুন্দর করে সাজাচ্ছে।শিউলি বসে বসে ভাবছে আজ সে প্রথম শাড়ি পরছে খুব সুন্দর করে সাজছে তাও আবার কারো ভোগ্য পাত্র হিসেবে কারো ভালো বাসার পাত্র হিসেবে নয়।শিউলি হাসছে এই ভেবে যে মন্ত্রী ব্যাটা পাজি হলেও পছন্দ আছে নীল রংয়ের শাড়ি।যেই মেয়েটা শিউলিকে সাজাচ্ছিল সে ভীতসন্ত্রস্ত ভাবে শিউলিকে দেখছে  আর ভাবছেএ কেমন মেয়ে যে এমন পরিস্তিতিতেও হাসছে।সে অনেক মেয়েকে এভাবে সাজিয়েছে সবাই ই হাতে পায়ে ধরেছে চলে যাবার জন্য,খুব কেঁদেছেও।আর এ কেমন মেয়ে যে হাসছে,দেখেতো মনে ও হচ্ছে না যে খারাপ মেয়ে।শিউলি হেসেই যাচ্ছে আস্চর্যের বিষয় মেয়েটা শিউলির খোপায় যে ফুল লাগিয়েছে তা শিউলি ফুলই।এ হয় তো সৃষ্টিকর্তার এক রহস্য।যার কোনো উত্তর নেই।

রাতে কেটে সকাল হয়েছে শিউলিকে মন্ত্রী বলল যাও গোসল করে নাও তোমাকে ওরা নিয়ে যাবে।শিউলি একটা হাসি দিয়ে বলল “স্যার বেশ্যার আবার গোসল!”বলেই সে নিশব্দে গোসলখানায় চলে গেলো।মন্ত্রী আশ্চর্য দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকিয়ে রইলো।

শিউলি গোসল সেরে বের হলো।বারান্দায় মন্ত্রীর লোকেরা দাঁড়িয়ে ছিলো শিউলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।শিউলি বুঝতে পেড়ে কিছু না বলেই বেরিয়ে যেতে লাগলো।মন্ত্রী পিছন থেকে ডেকে বলল “এই মেয়ে দাঁড়াও”শিউলি পিছন ফিরে এসে  মন্ত্রীর সামনে দাঁড়ালো।মন্ত্রী শিউলিকে বলল বিছানায় বসতে।শিউলি বিছানায় বসে মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল “স্যার কিছু বলবেন?”মন্ত্রী খানিকক্ষন শিউলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলো”তোমাকে আমি যত দেখছি অবাক হচ্ছি,তুমি আমাকে চমকে দিতে এমন করছো কিনা আমি জানি না।আজ পর্যন্ত যত মেয়েই এসেছে তাদের পাঁচের চার জনের চোখে ভয়,আকুতি দেখেছি,কেউ কেঁদেছে,কেউ পায়ে ধরেছে আর বাকি এক জন খারাপ বলে সাচ্ছন্দে মেনে নিয়েছে কিন্তু তোমাকে এদের কোনো দলেই ফেলতে পাড়ছি না।তুমি খারাপ নও কিন্তু ভয়ও পাচ্ছ না,কিন্তু কেন জানতে পারি?”খানিক থেমে তিনি আবার বললেন “তোমার কাছ থেকে উত্তর পাবো না জানতাম।তবুও জিঞ্জাস করলাম।”শিউলি মন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিলো”যে দেশে দিনের পর দিন শশুড়ের হাতে পুত্রবধূ,মামার হাতে ভাগ্নী,ভাইয়ের হাতে বোন,বাবার হাতে মেয়ে যৌন হয়রানি,ধর্ষনের শিকার হচ্ছে সেখানে মন্ত্রীর আর কিবা দোষ আর কি উত্তরই বা দেবার আছে আমার,মেনে নেওয়া ছাড়া আমি যে অসহায় নারী।

রাতে শিউলির ঘরে টোকা দিলো রানী বিবি।শিউলি দরজা খুলে দিলো।রানী বিবি শিউলিকে দড়াজ গলায় বলল “ঔ ছেড়ি রেডি হইয়া নে কাস্টমার আইতাছে,কোনো ঝামেলা যদি করস তাইলে আমার চে খারাপ কেউ হইবো না।তয় তরে দেইখা মনে হইতাছে তুই আর গুলার মত ঝামেলা খুব একটা করবি না।তারাতারি মাইনা নেওনি ভালা।যাই হোক  মাশাল্লাহ্ চেহারা ছুরত ভালা, গতরও ভালা,কাস্টমাররে খুশি কইরা দিছ কিন্তু।”

মাস ছয়েক কেটে গেলো।শিউলি ঘর থেকে খুব একটা বের হয় না।কারো সাথে কথাও বলে না।আজ শিউলির মামির জন্য খুব মন খারাপ লাগছিলো কত দিন তাকে দেখে না।তাছাড়া রাবু তো নিশ্চই তাকে খুঁজে না পেয়ে হয়তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। শিউলি এত দিনে এখানকার বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে।এতদিন বললে হয়তো যেতেও দিতো না,এখন আর বাধা দিবে না।

বিকেলে শিউলি নিজের ঘরে তালা দিয়ে রওনা দিলো রানী ডেকে জিঞ্জাস করলো “কিরে শিউলি কই যাস কোনো কাস্টমারের বাসায় খ্যাতা গরম করতে?”শিউলি কিছু না বলে গাল বাঁকিয়ে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।

রাত দশটার দিকে শিউলি মামা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে মামি কলে দুটো ডাক দিতেই রাবু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে শিউলিকে।মামি যেন ওর জন্যই অপেক্ষায় ছিলো।কিছুতেই বরাবুর কান্না যেন থামছিলোই না। শিউলি কে তার হাজার প্রশ্ন কোথায় চলে গিয়েছিলিস,কেন গিয়েছিলি,এখন কই আছিস,কেমন আছিস ইত্যাদি।

ঘন্টা খানিক কেঁদে রাবু থামলো।শিউলিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো সে।খাবার পরে শিউলি রাবুর কোলে মাথা

দিয়ে সুয়ে পড়লো।রাবু মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল”তোকে একটা কথা জিঞ্জাস করবো?”শিউলি বলল “তুমি কি জিঞ্জাস করবে আমি জানি!,আমি কি করি তাইতো?তুমি যা শুনেছো তাই ই সত্যি মামি।রাবু বলল”কিন্তু কিভাবে?”শিউলি সব ঘটনা খুলে বলল।রাবু সবটা শুনে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো শিউলির কপালে।শিউলি উঠে বসলো এবং হাহাহা করে হাসতে লাগলো,ওর হাসিটা যেন রাবুর কলিজা ছিঁড়ে নিচ্ছিল এ তো হাসি নয় যেন ছোট্ট একটা বুকে চেপে থাকা এক বিশাল কষ্টের সমুদ্রের গর্জন।হাসতে হাসতে শিউলি বলল “মামি শোনো এই জীবনটার একটা ভালো দিকও রয়েছে ওখানে প্রতিটা নারী যেন একটা শক্তি।এরা সবাই প্রতিবাদিনী, স্বাধীন।যে যার মত চলে দেখার কেউ নেই,বাধা দেয়ার কেউ নেই।প্রতিটা রাতে পুরুষগুলো এসে পায়ের উপর হুমরি খেয়ে পড়ে।নারীকে তখন দেবী মানে দেবী।জানো তো মামি এই স্বাধীনতা,শক্তি গুলো সভ্য সমাজের একজন উপার্জনকারী নারীর নেই।যদি কোনো চাকুরীজীবী নারীর একদিন বাসায় ফিরতে দেরি হয় সেদিনই কইফিয়ত দিতে হয় বা মার খেতে হয় এমন কি নিজের উপার্জিত অর্থও কখনো কখনো পুরুষেরর হাতে তুলে দিতে হয়,হিসাব দিতে হয়।কিন্তু খারাপ সমাজে তা করতে হয় না।শিউলি তখনও হেসেই চলছিলো।

রাবু কাঁদতে কাদতে শিউলিকে বললো “তোর আর ওখানে যেতে হবে না।এখানে তোর নানির দেয়া তোর নামে বেশ কিছু জমি আছে সেটা বিক্রি করে তোকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবো।যেখানে তোকে কেউ চিনবে না।শিউলি কোনো কথা বলল না।গল্প করতে করতে রাত প্রায় আড়াইটা বাজে তখন মতিন মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে।

শিউলিকে দেখে সে তেড়ে ওঠে।রাবু মতিনকে বলে শিউলির জমি তাকে ফিরিয়ে দিতে।এ নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়,মতিন বলে “ও কিসের জমি পায় আমার কাছে ও আমাদের কে?ওর মা ই তো কেউনা আমাদের ওর মাকেই তো লঞ্চঘাটে কুঁড়িয়ে পেয়েছিল বাবা।”

শিউলি বারান্দায় বসে কথাটা শুনে ফেলে।শিউলি একটা দির্ঘ্য শ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে উঠানে নেমে হাটতে থাকে আজ এ কথাটা শুনে ওর বুক থেকে যেন একটা ভারি পাথর নেমে গেছে।এতদিন ওর খুব কষ্ট হতো এটা ভেবে যে মামার কাছেও ভাগ্নি নিরাপদ না তাহলে কোথায় যাবে মেয়েরা। কিন্তু আজ ওর সেই খারাপ লাগার অবসান ঘটেছে অন্ততপক্ষে মামা জাতিটা তো কলঙ্কমুক্ত হলো।

শিউলি হাটছিল তার গন্তব্যের দিকে,মাথার উপরে মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে।শিউলির মনে হচ্ছে চাঁদটা যেন আজ একটু বেশিই সুন্দর,নিষ্কলঙ্ক।শিউলি মনে মনে বিরবির করতে লাগলো “কইতরী খালাকে তো ঠিকানা দিয়ে এলাম মামিকে দিবে তো?”আর না দিলে কি বা করার।তবে দিতে পাড়ে আচড়নে মনে হলো মামার সাথে ঝামেলা চলেছে।

শিউলির ঠিকানায় অর্থাৎ পাড়ার সামনে মঞ্জুর ফার্মেসীতে প্রায়ই রাবুর চিঠি আসে।হঠাৎ করে একদিন শিউলি চিঠির খামটা খুলে দেখে একটা জমির দলিল।আর সাথে একটা চিঠি।

শিউলি

জমির দলিলটা চুরি করে পাঠালাম এটা বিক্রি করে দূরে কোথাও  চলে যাস।পারলে কইতরীকে তোর সাথে নিস,ও নিজের ভুল বুঝতে পেড়েছে,তাছাড়া তোর মামার টাকায় ওর ক্যান্সার আক্রান্ত বাবার চিকিৎসা আর সংসার দুটোই চলতো মায়ের ও এক হাত নেই।যাই হোক বাদ দে।তোকে একটা কথা বলি”তোর মা জ্বরে মারা যায়নি তাকে তোর মামা গলা টিপে মেরেছিলো।আমি নিজের চোখে দেখেও তখন কাউকে কিছু বলতে পারিনি আর লাভও হত না,ও টাকার জোরে ঠিকই ছাড়া পেয়ে যেত আর তুইও তখন ছোটো ছিলি তাই বলিনি কিন্তু তোর এখন জানা উচিৎ।পারলে প্রতিশোধ নিস।আর এটাই হয়তো আমার শেষ চিঠি।আমি বেশ বুঝতে পারছি তোর মামা আমাকেও মারার চেষ্টা করছে।ভালো থাকিস,নিজের খেয়াল রাখিস।

-মামি।

বেশ কয়েক দিন ধরে শিউলির মামির জন্য মন খারাপ লাগছিলো কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠছিলো না।

হঠাৎ একদিন রাত প্রায় তিনটার দিকে শিউলির দরজায় কেউ জোড়ে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো।শিউলি ভিতর থেকে বলল “কে আবার দরজায় মরে,শেষ রাইতে আবার কার লাগবো,অন্য ঘরে যা আইজ আমি পারুম না।”দড়জার ওপার থেকে একটা মহিলা কন্ঠ ভেসে এলো “শিউলী দরজা খোল আমি।”শিউলি দরজা খুলে হতবাক দড়জায় ভেজা কাপড়,পায়ে কাঁদা মাখা অবস্থায় কইতরী দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে।শিউলি বুঝতে পাড়লো মামির নিশ্চই কিছু হয়েছে।শিউলি কইতরীকে ধরে দরজার সামনেই বসালো।আর গম্ভীর কন্ঠে বলল”খালা মামিরে মাইরা ফেলছে তাইনা?”কইতরী হাউমাই করে কেঁদে উঠলো।শিউলি কইতরীকে এক গ্লাস পানি দিয়ে বলল খেয়ে নাও।

কইতরীকে নিয়ে রওয়া হলো শিউলি।বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল সাড়ে ছয়টা নাগাত বেজে গেল ততক্ষণে ফজরের আযানের পর মতিন মাইকে জানিয়ে দিয়েছে রাবু রাতে স্ট্রোক হয়ে মারা গেছে।শিউলিরা পৌঁছে দেখে বাড়ির উঠানে বেশ মানুষজন,ভিতরে অনেক মহিলারা আর মতিন পাঞ্জাবী পরে হাতে তজবি নিয়ে উঠানে পাটিতে বসে কান্নার অভিনয় করছে।শিউলিকে দেখে উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলতে শুরু করে,”মা কারে আর দেখবি সে তো চলে গেছে,আর আসবে না” ইত্যাদি ইত্যাদি।শিউলি চুপ করে সহ্য করে।মতিন শিউলির কোনো সাড়া না পেয়ে ওকে ছেড়ে দেয়ে।শিউলি ঘরে ঢোকে ওকে দেখে লাশের পাশে বসা মহিলারা হুহু করে  কেঁদে ওঠে।শিউলি  লাসের পাশে না গিয়ে সোজা দোতলার ঘরে যায়।

খানিকবাদে একখানা ধারালো রামদা উচু করে নিয়ে শিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে।ওর চোখ মুখ থেকে যেন  আগুন ঝড়ছে।শিউলি উঠানে নেমে মতিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।উঠানের সবাই কিছু বোঝার আগেই মতিনের গলায় পরাপর পাঁচ ছয়টা কোপ বসিয়ে দেয়।মতিনের মাথাটা উঠানের ধুলায় পরে লাফাতে থাকে।খানিকবাদে দেহটা মাটিতে পরে যায় গল গল করে রক্ত ছোটে। শিউলি রামদা টা ওখানেই ফেলে হরহর করে বমি করতে থাকে…..

 

 

 

 

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here